Let your mind to be opened to explore the truth
This is my way (ISLAM); I invite to Allah with insight :12-No Sura Yousuf: Verse-108.”

দ্বাদশ অধ্যায়

ইসলামী দাওয়াহ বহন করার পদ্ধতি

নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও গবেষক শাইখ তাকী উদ্দীন আন-নাবহানি (রাহিমাহুল্লাহ) কর্তৃক লিখিত নিযামুল ইসলাম বইটির খসড়া অনুবাদ-এর একাংশ হতে গৃহীত

 

ইসলাম অনুসরণ করার কারণে মুসলিমরা বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়েনি, বরং তাদের অধঃপতন শুরু হয়েছে যখন থেকে তারা ইসলামকে অনুসরণ করা ছেড়ে দিয়েছে, তাদের ভুমিতে বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশের সুযোগ দিয়েছে এবং তাদের মন পশ্চিমা ধ্যান ধারণায় আচ্ছন্ন হতে দিয়েছে। তাদের অধঃপতন শুরু হয়েছে যখন তারা ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে পরিত্যাগ করেছে, এর দাওয়াহকে অবহেলা করেছে এবং এর নিয়মকানুন (আহকাম) গুলোর অপপ্রয়োগ করেছে। কাজেই পুনর্জাগরণের জন্য মুসলিমদের ইসলামী জীবন যাত্রা পুনরায় শুরু করতে হবে। অবশ্য তাদের এ ইসলামী জীবন যাত্রার পুনরাবৃত্তি সম্ভব হবেনা যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের মাধ্যমে পুনরায় ইসলামী দাওয়াহ শুরু করবে এবং এই দাওয়াহর মাধ্যমে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সম্ভব হবে যে রাষ্ট্র ইসলামের প্রতি আহবানের মাধ্যমে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব বহন করবে।

 

এক্ষেত্রে পরিস্কার থাকা জরুরী যে মুসলিমদের পুনর্জাগরণের জন্য ইসলামী দাওয়াহ'র মাধ্যমে ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বকে বহন করতে হবে, এটা একারনে যে একমাত্র ইসলামই সমগ্র বিশ্বকে পরিশুদ্ধ করতে পারে এবং এ কারনেও যে প্রকৃত পুনর্জাগরণ ইসলাম ব্যতিত সম্ভব নয়, তা মুসলিমদের জন্যই হোক কিংবা অমুসলিমদের জন্যই হোকনা কেন। এরই ভিত্তিতে ইসলামী দাওয়াহর কাজটি সামনে এগিয়ে নিতে হবে।

 

বিশ্বের কাছে দাওয়াহ কে নিয়ে যেতে হবে একটি বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব হিসেবে যা থেকে সকল ব্যবস্থা বিকশিত হয় এবং এই বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের উপর ভিত্তি করেই সকল চিন্তাধারা গঠিত, এবং কোন ব্যতিক্রম ছাড়াই, এইসব চিন্তাধারা থেকেই জীবনের প্রতিটি দৃষ্টিভঙ্গীর উপর প্রভাববিস্তারকারী ব্যক্তির সকল ধারণা বিকশিত হয়।

 

বর্তমানে দাওয়াহ করতে হবে ঠিক যেমনি ভাবে অতীতে দাওয়াহ হয়েছিল এবং তা রাসূলুল্লাহ (সা) এর দৃষ্টান্তের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হবে। এক্ষেত্রে তার পদ্ধতি (Method) থেকে সাধারণভাবে কিংবা সূক্ষাতিসূক্ষ বিষয়গুলোতে সামান্যতম বিচ্যূতিরও সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে যুগের পার্থক্য কোনরূপ গুরুত্ব বহন করেনা, কারণ এ পার্থক্য শুধুমাত্র উপায় ও ধরণেই (Means & Style) সীমাবদ্ধ। কিন্তু যুগ কিংবা স্থান পরিবর্তনের ফলে মানব জীবনের মৌলিক বিষয়াদি (essence) ও বাস্তবতা (reality) পরিবর্তিত হয়নি, এবং কোন দিন তা পরিবর্তিত হবেওনা।

 

কাজেই দাওয়াহর জন্য প্রয়োজন স্পষ্টবাদিতা, সাহস, শক্তিমত্তা, চিন্তাধারা ও ইসলামী ফিকরাহ ও তরীকাহর (আদর্শ ও পদ্ধতি) সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ যে কোন কিছুর মুখোমুখি হয়ে তার অসারতা কে চ্যালেঞ্জ করার মনোভাব, এক্ষেত্রে পরিস্থিতি ও এর পরিনতি যাই হোক না কেন।

 

চূড়ান্ত সার্বভৌমত্ব (সিয়াদা) যে ইসলামী আদর্শের জন্য, ইসলামী দাওয়াহ এ বিষয়টির অপরিহার্যতাই তুলে ধরে, তা অধিকাংশ লোকের পছন্দ হোক বা না হোক, তাদের নিকট গৃহীত হোক বা প্রত্যাখ্যাত হোক কিংবা তারা এর বিরুদ্ধাচারণ করুক, প্রচলিত প্রথার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হোক বা না হোক (এগুলোর কোনটাই বিবেচ্য বিষয় নয়)।

 

দাওয়াহকারীগণ (হামিলুদ দাওয়াহ) মানুষকে তোষামোদ করেনা, কর্তৃপক্ষের প্রতি সৌজন্য প্রদর্শন করেনা, কিংবা মানুষের প্রচলিত ঐতিহ্য ও রীতি নীতিকে গ্রাহ্য করেনা, এবং মানুষ তাকে গ্রহণ করবে কি করবে না তার প্রতিও মনোযোগ দেয়না। বরং সে শুধুমাত্র আদর্শের প্রতি অনুগত থাকে এবং অন্য কোন কিছুর প্রতি মনোযোগ না দিয়ে জীবনাদর্শটি প্রচার করে। তার জন্য অন্য আদর্শের অনুসারীদের তাদের স্বীয় আদর্শে অনুগত থাকার কথা বলা অনুমোদিত নয়। বরং তাদের প্রতি কোনরূপ বল প্রয়োগ ছাড়াই ইসলামী জীবনাদর্শ গ্রহণ করার আহ্বান জানানো হয়, কারণ দাওয়াহর দাবী হচ্ছে, ইসলামের পাশাপাশি অন্য কোন জীবনাদর্শ থাকবেনা এবং সার্বভৌমত্ব কেবল ইসলামেরই জন্য।

 

"তিনিই প্রেরণ করেছেন রাসূলকে হিদায়াত ও সত্য দ্বীন সহ যাতে তা অন্য সকল ব্যবস্থার উপর জয়যুক্ত হতে পারে যদিও বা মুশরিকরা তা অপছন্দ করে।" (সুরা তাওবা: আয়াত ৩৩)

 

রাসূলুল্লাহ (সা) এ পৃথিবীতে এসেছিলেন তার সত্যবাণী (রিসালাত) সহ এবং তিনি সমগ্র বিশ্বের প্রতি প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন। তিনি (সা) যে সত্যের প্রতি মানুষকে আহ্বান করতেন তা তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এবং তিনি সকল লাল কালো (মানুষের) অর্থাৎ সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, এক্ষেত্রে ঐতিহ্য, প্রথা, ধর্ম, আদর্শ, শাসক ও জনগণ ইত্যাদি কোন বিষয়কেই তিনি গ্রাহ্য করেননি। রাসুলুল্লাহ (সা) ইসলামের বাণী ব্যতিত আর কোন কিছুর প্রতিই মনোযোগ দেননি। তিনি কুরাইশদের মিথ্যা উপাস্যগুলোকে উপেক্ষা করে ইসলামের দাওয়াহ শুরু করেন। তিনি তাদের আদর্শকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন, তাদের অস্বীকার করেছিলেন অথচ তিনি ছিলেন একা, বিচ্ছিন্ন, তার কোন সাহায্যকারী ছিলনা, তার অস্ত্রও ছিলনা, শুধুমাত্র ছিল ইসলামের প্রতি দৃঢ় ও গভীর আস্থা ও বিশ্বাস এবং এর প্রতিই তিনি আহ্বান করেছিলেন। তিনি (সা) তৎকালীন আরবদের প্রথা, ঐতিহ্য, ধর্ম ও আদর্শের প্রতি মনোযোগ দেননি। এ বিষয়ে তিনি সৌজন্যতা দেখাননি কিংবা তাদের গ্রাহ্য করেননি।

 

একই ভাবে, দাওয়াহ বাহকদের সবকিছুকেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তন্মধ্যে প্রতিকূলতার শিকার হতে হলেও, প্রচলিত প্রথা, ঐতিহ্য, ক্ষয়িষ্ণূ চিন্তাধারা, ধারণা, জনমত, ইত্যাদি যা কিছু ভ্রান্ত সবকিছুর বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জ করতে হবে। তাকে অপরাপর আদর্শ ও ধর্মকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে যদিও বা এতে সে ঐসব আদর্শ ও ধর্মের অনুসারীদের গোঁড়ামী ও উগ্রবাদের শিকার হতে পারে কিংবা ভ্রান্ত মতাবলম্বীদের শত্রুতার শিকার হতে পারে।

 

দাওয়াহর ক্ষেত্রে কোনরূপ ছাড় না দিয়ে (তা যতই ছোট হোক না কেন) ইসলামী আইনের পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের মানসিকতা থাকতে হবে। দাওয়াহকারী কোন রূপ আপোসরফা, ছাড় দেয়া, অবহেলা, স্থগিতকরণ বা বিলম্বন মেনে নেয় না। বরং সে দাওয়াহ'র বিষয়টিকে সামগ্রিকভাবে নিয়ে নিশ্চিতভাবে এর তাৎক্ষণিক সমাধানে সচেষ্ট হয়। সে সত্যের ক্ষেত্রে (বাধাদানকারী) কোন মধ্যস্থতাকারী গ্রহণ করেনা। রাসূলুল্লাহ (সা) সাকিফ গোত্রের প্রতিনিধিত্বকারী দলের তাদের মূর্তি আল-লাত-এর ধ্বংসের পূর্বে তিন বছর অক্ষত রাখার অনুরোধ গ্রহণ করেননি; তিনি তাদের ইসলাম গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসাবে সালাত থেকে অব্যহতি দেননি। তিনি তাদের অনুরোধ অনুযায়ী আল-লাত কে দুবছর এমনকি একমাসের জন্যও রাখাও মেনে নেননি। তিনি এ অনুরোধগুলো দৃঢ়ভাবে ও চূড়ান্তভাবে, কোনরূপ দ্বিধা ও পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই অস্বীকার করেন। কারণ খুব সহজভাবে, মানুষ হয় বিশ্বাস করবে অথবা করবেনা এবং চূড়ান্ত পরিণতি হয় জান্নাত অথবা জাহান্নাম। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের একটি অনুরোধ রেখেছিলেন, তা হচ্ছে তিনি তাদের নিজহাতে মূর্তিগুলো ধ্বংস করতে বাধ্য করেননি, বরং আবু সুফিয়ান ও আল মুগীরাহ ইবনে শু'বাহ কে মূর্তিগুলোকে ধ্বংস করার আদেশ দিয়েছিলেন। তিনি সুনিশ্চিতভাবেই পরিপূর্ণ আকীদা ও তা বাস্তবায়নে যা কিছু প্রয়োজন তা থেকে কম কিছুই গ্রহণ করেননি। এই বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তিনি (সা) বিভিন্ন উপায় ও ধরণ গ্রহণ করেছিলেন কারণ তা সরাসরি ইসলামী আকীদা'র প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত নয়। কাজেই ইসলামী দাওয়াহ প্রচারের ক্ষেত্রে ইসলামী ধারণার (ফিকরাহ) এবং এর প্রয়োগের পরিপূর্ণতার ব্যাপারে যত্নশীল হতে হবে। ইসলামী ফিকরাহ ও তরীকাহ'য় কোনরূপ আপোষ করা যাবেনা। এর দাবী অনুযায়ী যে কোন ওয়াসীলা (উপায়) ব্যবহারে কোন ক্ষতি নেই।

 

ইসলামী দাওয়াহর ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে এর প্রতিটি কাজই দাবি করে যে তার একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য (objective) থাকবে। এবং এটাও দাবি করে যে দাওয়াহ কারী সর্বদা লক্ষ্য ও তা অর্জনের জন্য (গৃহীত) কাজগুলো সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন থাকবে এবং এ লক্ষ্য অর্জনে বিরামহীনভাবে চেষ্টা করে যাবে। কাজেই দাওয়াহকারী কখনোই কাজ ছাড়া শুধুমাত্র চিন্তায়ই সন্তুষ্ট থাকবেনা, নয়তো এটি একটি ইন্দ্রিয়-অবসাদগ্রস্থ কল্পনাপ্রসূত দর্শনে পরিনত হবে (فلسفة خيالية مخدرة)তেমনি সে কোন লক্ষ্য ছাড়া শুধুমাত্র চিন্তা ও কাজেও সন্তুষ্ট থাকবেনা, নয়তো এটি তার জন্য একপ্রকার (ফলাফলবিহীন) বৃত্তাকার গতিতে (حركة لولبية) পর্যবসিত হবে যা চূড়ান্ত ভাবে ক্লান্তি ও হতাশা বয়ে আনে। বরং দাওয়াহকারীকে সার্বক্ষণিকভাবে, তার চিন্তার সাথে কাজের একটি যোগসূত্র স্থাপন করতে হবে এবং এ দুয়ের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে সে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে অর্জনে কাজ করবে যা সম্পন্ন করার একটি ব্যবহারিক উপায় থাকবে এবং পরিশেষে বাস্তব রূপ লাভ করবে।

 

রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কায় ইসলামের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব বহন করেছিলেন। তিনি যখন বুঝতে পারলেন, মক্কার অধিবাসীরা ইসলামকে ব্যবস্থা হিসাবে গ্রহণ করবেনা, তখন তিনি মদীনায় ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি মদীনায় রাষ্ট্র স্থাপন করেছিলেন, এভাবে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, এর বাণী পৌঁছিয়েছিলেন, এবং উম্মাহ কে তার অবর্তমানে ইসলাম প্রচারের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন এবং ঠিক তার অনুসৃত পদ্ধতিতেই অগ্রসর হবার বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। কাজেই মুসলিমদের খলীফার অবর্তমানে ইসলামের দাওয়াহ করার ক্ষেত্রে ইসলামের প্রতি আহ্বান ও ইসলামী জীবন ধারা ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কাজটিও অন্তর্ভূক্ত হতে হবে, যে রাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে এবং বিশ্ববাসীর কাছে প্রচারিত হবে। এভাবেই ইসলামী রাষ্ট্রের মাধ্যমে দাওয়াহ উম্মাহর মধ্যে ইসলামী জীবনধারা ফিরিয়ে আনা থেকে শুরু করে সমগ্র বিশ্ববাসীর নিকট একটি আহ্বানে পরিণত হবে এবং শুধুমাত্র ইসলামী বিশ্বে সীমাবদ্ধ স্থানীয় দাওয়াহর পরিবর্তে তা বিশ্বজনীন এক সার্বিক দাওয়াহতে পরিণত হবে।

 

ইসলামের প্রতি আহ্বানের মধ্যে পরিষ্কারভাবে বিদ্যমান মতাদর্শগুলোর সংশোধন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় করণ থাকতে হবে, এবং একে অবশ্যই জনগণের সমস্যার সমাধান দিতে হবে। যাতে করে জীবনের সর্বস্তরে দাওয়াহ স্বীয় ঔজ্জ্বল্যে স্পষ্ট হয়ে উঠে। রাসূলুল্লাহ (সা) মক্কার লোকদের নিকট নিম্নোক্ত আয়াত পাঠ করে শোনাতেন,

 

"ধ্বংস হোক আবু লাহাবের দুই হাত এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।" (সুরা লাহাব: আয়াত ১)

 

"নিশ্চয়ই এগুলো এক সম্মানিত রাসূলের কথা, এগুলো কোন কবির কথা নয়, তোমরা খুব সামান্যই তা বিশ্বাস কর।" (সুরা হাক্কাহ: আয়াত ৪০-৪১)

 

"ধ্বংস হোক যারা ওজনে কম দেয়, যারা নিজেরা বুঝে নেয়ার সময় পরিপূর্ণ পরিমাণ অনুযায়ী বুঝে নেয় কিন্তু অন্যকে দেয়ার সময় কম দেয়।" (সুরা মুতাফফিফিন: আয়াত ১-৩)

 

"এবং যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্ম করেছে, তাদের জন্য রয়েছে জান্নাত যার তলদেশে নহর প্রবাহিত হয়, এটিই সর্বোত্তম সাফল্য।" (সুরা আল বুরূজ: আয়াত ১১)

 

মদীনায় তিনি তিলাওয়াৎ করে শোনান,

 

"সালাত প্রতিষ্ঠা কর এবং যাকাত আদায় কর।" (সুরা বাক্বারাহ: আয়াত ৪৩)

 

তোমরা অভিযানে বের হয়ে পড় হালকা বা ভারী (রণসম্ভার) অবস্থায়, এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে নিজেদের জান দিয়ে, সম্পদ দিয়ে, এটিই তোমাদের জন্য উত্তম, যদি তোমরা তা বুঝতে।” (সুরা আত-তাওবা: আয়াত ৪১)

 

হে ঈমানদারগণ যখন তোমরা নিজেদের মধ্যে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের লেনদেন কর তখন তা লিপিবদ্ধ কর, তোমাদের মধ্য থেকে কোন ন্যায় সঙ্গত লেখক তা লিপিবদ্ধ করবে।” (সুরা আল বাক্বারাহ: আয়াত ৮২)

 

সম্পদ যেন শুধুমাত্র তোমাদের মধ্যে ধনীদের মধ্যেই আবর্তিত না হয়।” (সুরা হাশর: আয়াত ৭)

 

আগুনের অধিবাসীর ও জান্নাতের অধিবাসীরা সমান নয়, জান্নাতের অধিবাসীরাই সফলকাম।” (সুরা হাশর: আয়াত ২০)

 

এভাবেই ইসলামী দাওয়াহ'র মাধ্যমে মানুষের কাছে ইসলামী ব্যবস্থা নিয়ে যাওয়া উচিৎ যার মাধ্যমে তারা তাদের প্রতিদিনের সমস্যার সমাধান করতে পারে। কারণ ইসলামী দাওয়াহ সফল হওয়ার পেছনের রহস্য হচ্ছে এটি খুবই স্পষ্ট এবং মানুষের কাছে তার জীবনের সমাধান দেয়ার সময় সমস্যাগুলো মানবীয় সমস্যা (human problem) হিসেবে দেখে, এবং এর মাধ্যমে যাবতীয় সমস্যার আমূল পরিবর্তন ঘটায়।

 

দাওয়াহকারীদের পক্ষে দাওয়াহর দায়িত্ব পালন ও যথাযথভাবে তার কর্তব্য পালনের বিষয়টি অত্যন্ত দুরূহ যতক্ষণ পর্যন্ত না তাদের মনের অন্তঃস্থলে পরিপূর্ণতা অর্জনের তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রোথিত হয়। তাদের অবিরাম সত্যের সন্ধান ও তাদের লব্ধ জ্ঞানকে ক্রমাগত নিরীক্ষার মাধ্যমে স্বীয় উপলব্ধিকে বিজাতীয় চিন্তাধারা থেকে পরিশুদ্ধ করতে হবে এবং এধরণের বিজাতীয় চিন্তাধারা অর্থের দিক থেকে আপাত গ্রহণ যোগ্য মনে করে তাতে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে। এটি তাদের চিন্তা ধারণা কে পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ রাখতে সাহায্য করবে। শুধুমাত্র চিন্তার বিশুদ্ধতা ও পরিচ্ছন্নতা ইসলামের সাফল্য ও তা অব্যাহত রাখার নিশ্চয়তা প্রদান করে।

 

দাওয়াহকারীদের আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে এই বাধ্যতামূলক দায়িত্ব অবশ্যই পালন করতে হবে। তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রত্যাশায় এ কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাদের কাজের মাঝে কোন বৈষয়িক লাভ বা মানুষের প্রশংসা প্রত্যাশা করা উচিত নয়। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন ব্যতিত তাদের অন্য কিছুর পিছনেই ধাবিত হওয়া উচিৎ নয়।

  

Please note that this is not an official translation, rather a draft one. So, we would suggest not to spread this widely or publish this anywhere online for the time being.

 

খলীফা

 

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম শাইখ আতা ইবনু খলীল আল-রাশতা কর্তৃক লিখিত আজহিজাতু দাওলিাতিল খিলাফাহ - ফিল হুকমি ওয়াল ইদারাহবইটির বাংলা অনুবাদ এর একাংশ হতে গৃহীত)

 

খলীফা হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি যিনি শাসন, কর্তৃত্ব এবং শারী'আহ্'র বিধি-বিধান সমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ্'র প্রতিনিধিত্ব করেন। ইসলাম এটি নির্ধারণ করে দিয়েছে যে, শাসন ও কর্তৃত থাকবে উম্মাহ্'র অধিকারে।

 

এজন্যই উম্মাহ্ শাসনকার্য পরিচালনা ও তাদের উপর শারী'আহ্'র হুকুম-আহ্কাম সমূহ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার পক্ষ হতে একজনকে নিযুক্ত করে। বস্তুতঃ আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা প্রতিটি শারী'আহ্ আইন বাস্তবায়ন করা উম্মাহ্'র জন্য বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন। যেহেতু খলীফা মুসলিমদের দ্বারা নির্বাচিত হন, সেহেতু স্বভাবতই তাকে শাসন, কর্তৃত্ব ও শারী'আহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উম্মাহ্'র প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। সুতরাং, কোন ব্যক্তিই ততক্ষণ পর্যন্ত খলীফা হতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি উম্মাহ্'র কাছ থেকে বাই'আত প্রাপ্ত হবেন; কারণ, মূলতঃ শাসন, কর্তৃত্ব ও শারী'আহ্ আইনসমূহ বাস্তবায়ন করা উম্মাহ্'র এখতিয়ারে। প্রকৃতঅর্থে, একজন ব্যক্তিকে খলীফা হিসাবে বাই'আত দিয়েই মুসলিম উম্মাহ্ কার্যকরীভাবে তাকে উম্মাহ্'র প্রতিনিধি হিসাবে নিযুক্ত করে। আর, এই বাই'আতের মাধ্যমেই তার উপর খিলাফত রাষ্ট্রের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়, খলীফাকে (উম্মাহ্'র উপর) কর্তৃত্বশীল করা হয় এবং সর্বোপরি, উম্মাহ্কে তার আনুগত্য করতে বাধ্য করা হয়।

 

বস্তুতঃ যিনি মুসলিমদের শাসন করবেন, তিনি ততক্ষণ পর্যন্ত খলীফা হতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত না উম্মাহ্'র মধ্য হতে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ (আহ্লুল হাল্লি ওয়াল আকদ্) স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাকে বাই'আত প্রদান করেন। খলীফা হিসেবে নিয়োগ পাবার জন্য তাকে অবশ্যই বাধ্যতামূলক কিছু শর্ত পূরণ করতে হবে এবং তারপর তাকে শারী'আহ বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হতে হবে।

 

পদবি

 

খলীফার পদবি হতে পারে খলীফা অথবা 'ইমাম' কিংবা 'আমীর উল মু'মিনীন (বিশ্বাসীদের নেতা)। এই পদবিসমূহ সহীহ্ হাদীস এবং ইজ্মা আস্ সাহাবা (রা) থেকে পাওয়া যায়। খোলাফায়ে রাশেদীনদের (প্রথম চার খলীফা) এইসব পদবী দেয়া হয়েছিল। আবু সা'ঈদ আল খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

 

"যদি দুই জন খলীফাকে আনুগত্যের শপথ দেয়া হয়, তাহলে তাদের মধ্যে পরের জনকে হত্যা কর।" (সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং- ১৮৪২)

 

আবদুল্লাহ্ বিন আমর বিন আল আস্ (রা) থেকে হতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

 

"যখন একজন ইমামের হাতে বাই'আত গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে যথাসাধ্য মান্য করবে..." (সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-১৮৪৪)

 

আউফ ইবনে মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, "রাসূল (সাঃ) বলেছেন,

 

"তোমাদের ইমামদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হচ্ছে তারা যারা তোমাদেরকে ভালবাসে এবং তোমরা তাদেরকে ভালবাসো এবং যারা তোমাদের জন্য প্রার্থনা করে এবং তোমরা যাদের জন্য প্রার্থনা কর;... " (সহীহ্ মুসলিম, হাদীস নং-৪৭৮২)

 

এসব হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, ইসলামের নিয়ম অনুসারে শাসকদের পদবি হল খলীফা অথবা ইমাম।

 

"আমীর উল মু'মিনীন" উপাধির ব্যাপারে সবচাইতে নির্ভরযোগ্য হাদীসটি এসেছে শিহাব আল জুহরী'র বর্ণনা থেকে। এ হাদীসটি আল-হাকিম তার মুসতাদরাক গ্রন্থে (খন্ড-৩, পৃষ্ঠা-৭৩, হাদীস নং-৪৪৮০) উল্লেখ করেছেন এবং আল-জাহাবী (তালখিস গ্রন্থে) এটিকে সহীহ্ হাদীস বলে উল্লেখ করেছেন। একই বিষয়ে আল-তাবারাণীর একটি বর্ণনা পাওয়া যায় যেটি সম্পর্কে আল-হাইছামী বলেছেন, এ হাদীসের বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। আল-হাকিম হাদীসটি এভাবে বর্ণনা করেছেন যে :"ইবনে শিহাব বর্ণনা করেছেন যে, উমর ইবন আব্দুল আজিজ, আবু বকর ইবন সুলাইমান ইবন আবি হাইছামাকে জিজ্ঞেস করেন যে, "কে প্রথম আমীর উল মু'মিনীন উপাধি লিখতে আরম্ভ করেন? তিনি বলেন, "আশ-শিফা', যিনি নারীদের মধ্যে সর্বপ্রথম হিজরতকারী ছিলেন, আমাকে বললেন যে, উমর ইবন আল-খাত্তাব (রা) ইরাকের গভর্ণরকে পত্র মারফত দু'জন সত্যনিষ্ঠ ব্যক্তিকে পাঠানোর আদেশ দিলেন যেন তিনি (রা) তাদের কাছ থেকে ইরাক এবং সেখানকার জনগণ সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে পারেন। তিনি (ইরাকের গভর্ণর) লাবিদ ইবন রাবিয়াহ্ এবং আদি ইবন হাতিমকে তাঁর কাছে পাঠালেন।

 

মদিনায় এসে পৌঁছানোর পর তারা তাদের উটগুলোকে (মদিনার) মসজিদ প্রাঙ্গনে থামালেন এবং মসজিদের ভেতর প্রবেশ করলেন। হঠাৎ তারা আমর ইবন আল-আসকে দেখলেন এবং বললেন, "হে আমর! আমীর উল মু'মিনীনের সাথে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতির ব্যবস্থা করে দাও!" আমর বললেন, "আল্লাহ'র কসম, তোমরা তাঁকে সঠিক নামেই ডেকেছো। তিনি হচ্ছেন আমাদের আমির, আর আমরা হচ্ছি বিশ্বাসী (মু'মিনীন)।" তারপর আমর লাফিয়ে উঠে উমর, আমির উল মু'মিনীনের কক্ষে প্রবেশ করলেন এবং বললেন, "আস্সালামু আলাইকুম, হে আমীর উল মু'মিনীন (আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক, হে বিশ্বাসীদের আমীর)। উমর (রা) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার মাথায় এ উপাধি কিভাবে আসলো, হে আমর? আল্লাহ্'র কসম, তুমি যা বলেছো (এটা যে ঠিক) তা তোমাকে প্রমাণ করতে হবে।" তখন তিনি (আমর) বললেন, "লাবিদ ইবন রাবিয়াহ্ এবং আদি ইবন হাতিম মদিনায় এসে পৌঁছেছে এবং তারা তাদের উটগুলো মসজিদ প্রাঙ্গনে বেঁধে রেখে আমাকে বলেছে, "হে আমর! আমীর উল মু'মিনীদের সাথে আমাদের সাক্ষাতের অনুমতির ব্যবস্থা করে দাও। আল্লাহ্'র কসম! তারা আপনাকে সঠিক উপাধিই দিয়েছে। কারণ, আমরা হলাম বিশ্বাসী (মু'মিনীন) আর আপনি হলেন আমাদের আমীর (নেতা)।" তারপর থেকেই তারা তাদের লেখনীতে আমীর উল মু'মিনীন উপাধি ব্যবহার করতে আরম্ভ করেন।" আশ-শিফা (রা) ছিলেন আবু বকর ইবন সুলাইমানের নানী। এরপর থেকে উমর (রা) এর পরের খলীফাদেরও মুসলিমরা এই উপাধিতে সম্বোধন করতে আরম্ভ করে।"

 

খলীফা হওয়ার শর্তাবলী

(নিম্নোক্ত প্রবন্ধটি বিশ্বখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ও আলেম শাইখ আতা ইবনু খলীল আল-রাশতা কর্তৃক লিখিত আজহিজাতু দাওলাতিল খিলাফাহ - ফিল হুকমি ওয়াল ইদারাহ বইটির বাংলা অনুবাদ এর একাংশ হতে গৃহীত)

একজন ব্যক্তিকে খলীফা পদের জন্য এবং বাই'য়াতের জন্য বৈধভাবে উপযুক্ত হতে হলে তাকে সাতটি শর্ত পূর্ণ করতে হবে। এ সাতটি শর্ত অবশ্যই পূরণীয়। যদি এদের মধ্যে কোন একটির ব্যত্যয় ঘটে, তাহলে তিনি খলীফার পদের জন্য অনুপযুক্ত হবেন।

 

অবশ্য পূরণীয় শর্ত সমূহ:

 

প্রথমত: খলীফা অবশ্যই মুসলিম হবেন।

 

কাফেরদের জন্য এ পদ সংরক্ষিত নয় এবং তাকে মানতেও মুসলিমরা বাধ্য নয়। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন:

 

"আর মুসলিমদের উপর কাফেরদের কর্তৃত্ব করার কোন পথই আল্লাহ অবশিষ্ট রাখেননি।" [সূরা আন-নিসা: ১৪১]

 

শাসন করা হল শাসিতের উপর শাসকের শক্তিশালী অবস্থান। সে কারণে লান’ (কখনওই না) শব্দটি দিয়ে মুসলিমদের উপর কাফিরদের কর্তৃত্ব করবার (খলীফা বা অন্য কোন শাসন সংক্রান্ত পদ) ব্যাপারটি সন্দেহাতীত ভাবে নিষিদ্ধ (categorical prohibition) হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ কারণে কাফেরদের শাসন মেনে নেয়া মুসলিমদের জন্য হারাম।

 

যেহেতু খলীফা একজন কর্তৃত্বশীল ব্যক্তি এবং আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা তাকে মুসলিমদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল করেছেন সেহেতু তাকে মুসলিম হতে হবে। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন,

 

"হে ঈমানদারগণ; আলাহ্‌'র নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বশীল (উলীল আমর) তাদের" [সূরা আন-নিসা: ৫৯]

 

তিনি (আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) আরও বলেন,

 

"তারা যখনই কোন প্রকার জননিরাপত্তা সংক্রান্ত কিংবা ভীতিকর খবর শুনতে পায়, তখনি তা সর্বত্র প্রচার করে দেয় অথচ তারা যদি তা রাসূল ও তাদের উপর কর্তৃত্বশীল ব্যক্তিদের (উলীল আমর) কাছে পৌছে দিত।" [সূরা আন-নিসা: ৮৩]

 

উলীল আমর শব্দ দুটি সব সময় মুসলিমদের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়া অন্য কোন অর্থে এদের ব্যবহার করা হয়নি। এটা প্রমাণ করে যে, তাদেরকে (কর্ততৃশীল বা উলীল আমর)) সব সময় মুসলিম হতে হবে। যেহেতু খলীফা পদ হচ্ছে সর্বোচ্চ কর্তৃত্বশীল পদ এবং তিনিই অন্যান্যদের কর্তৃত্বশীল পদে নিযুক্ত করবেন, যেমন: তার সহকারীগণ, ওয়ালী, আমীল প্রমুখ, সেহেতু তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে।

 

দ্বিতীয়ত: খলীফাকে অবশ্যই পুরুষ হতে হবে।

 

মহিলাদের খলীফা হবার কোন বিধান নেই অর্থাৎ কোন নারী খলীফা হতে পারবেন না। বুখারী থেকে বর্ণিত যে, রাসূল (সা) যখন শুনলেন পারস্যের জনগণ কিসরার কন্যাকে তাদের রাণী হিসেবে নিযুক্ত করেছে, তখন তিনি (সা) বললেন,

 

"যারা নারীদেরকে শাসক হিসেবে নিযুক্ত করে তারা কখনওই সফল হবে না।"

 

যেহেতু রাসূলুল্লাহ (সা) এই হাদীসে যারা তাদের বিষয়সমূহ নিষ্পত্তির জন্য নারীদের শাসক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে তাদের সফল না হবার ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, সেহেতু তিনি এ ব্যাপারটি নিষিদ্ধ করেছেন। অর্থাৎ যারা নারীদের তাদের বিষয়াবলী নিষ্পত্তির জন্য শাসক হিসেবে নিযুক্ত করবে তাদেরকে সাফল্য পরিত্যাগ করবে এবং এখানে 'সাফল্য পরিত্যাগ করবে' শব্দের ব্যবহার হবার কারণে এ নিষেধাজ্ঞাটি অকাট্য (Decisive) বলে গণ্য হবে, অর্থাৎ একজন মহিলাকে ওয়ালী হিসেবে নিয়োগ দান হারাম। সে কারণে নারীদের জন্য যে কোন শাসকের পদ অলংকৃত করা সেটি খলীফা কিংবা অন্য কিছু হোক সেটা হারাম। এর কারণ হচ্ছে হাদীসের বিষয়বস্তু শুধুমাত্র কিসরার কন্যার রাণী হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি শাসনের সাথে বিজড়িত। আবার হাদীসটি সব বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় যেমন বিচারব্যবস্থা, শূরা কাউন্সিল, শাসকদের জবাবদিহি করা কিংবা নির্বাচনে ভোট দিতে পারা ইত্যাদি। বরং এসবই নারীদের জন্য বৈধ, যা পরবর্তীতে আলোচিত হবে।

 

তৃতীয়ত: খলীফাকে অবশ্যই বালেগ হতে হবে।

 

নাবালেগ কাউকে খলীফা হিসেবে নিযুক্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবু দাউদ, আলী (রা:) থেকে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেন:

 

"জবাবদিহিতা তিন ব্যক্তির জন্য নয়: ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জেগে উঠে, বালক যতক্ষণ না প্রাপ্তবয়স্ক হয় এবং উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষণ না সে মানসিকভাবে সুস্থ হয়।"

 

আলী (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন:

 

"তিন ব্যক্তির আমল নামায় কিছুই লেখা হয় না: উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষন না সে সুস্থ হয়, ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষন না সে জেগে উঠে এবং নাবালেগ যতক্ষন না সে বালেগ হয়।"

 

অর্থাৎ যার উপর থেকে বিচারের কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে সে তার কাজের জন্য দায়ী হবে না। তার কোন শরীয়াগত দায়দায়িত্ব নেই। যে ব্যক্তি নিজের কর্মকান্ডের জন্য দায়িত্বশীল নয় তাকে সে কারণে খলীফাও বানানো যাবে না। এ ব্যাপারে আরও দলিল পাওয়া যায় বুখারীর কাছ থেকে যিনি বর্ণনা করেছেন আবু আকীল জাহারা ইবনে মা'বাদ থেকে; তিনি বর্ণনা করেছেন তার দাদা আবদুলাহ ইবনে হিশাম থেকে যিনি রাসূল (সা:) এর সময় জীবিত ছিলেন। ইবনে হিশামের মা তাঁকে রাসূলুলাহ (সা:) এর কাছে নিয়ে গেলেন এবং বললেন, 'হে আল্লাহর রাসূল! তাঁর কাছ থেকে বাই'য়াত গ্রহণ করুন।' তখন রাসূল (সা:) বললেন, 'সে তো ছোট'অতঃপর তিনি (সা:) আবদুল্লাহ ইবনে হিশামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন এবং তার জন্য দোয়া করলেন। সুতরাং নাবালেগের বাই'য়াত যেহেতু গ্রহণযোগ্য নয় সেহেতু তার পক্ষে খলীফা হওয়াও সম্ভবপর নয়।

 

চতুর্থত: খলীফাকে সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে।

 

অসুস্থ মস্তিষ্কের কোন ব্যক্তি খলীফা হতে পারবে না। কারণ রাসূল (সা) বলেন:

 

"তিন ব্যক্তির আমল নামায় কিছুই লেখা হয় না: উম্মাদ ব্যক্তি যতক্ষন না সে সুস্থ হয়..." বলতে বুঝানো হয়েছে অপ্রকৃতস্থ ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত জবাবদিহিতার আওতায় আসবে না যতক্ষন সে মানসিকভাবে সুস্থ হয়। কারণ মানসিক সুস্থতা যে কোন দায়িত্ব অনুভব করবার জন্য একান্ত প্রয়োজন। খলীফা আইন গ্রহণ করেন এবং বাস্তবায়ন করেন। সে কারণে একজন অপ্রকৃতস্থ খলীফা থাকা বৈধ নয়, কারণ যে ব্যক্তি নিজের ব্যাপারে দায়িত্বশীল নয় সে ব্যক্তি কি করে উম্মাহ্‌র ব্যাপারে দায়িত্বশীল হবেন?

 

পঞ্চমত: খলীফা ন্যায়পরায়ণ হবেন।

 

কোন ফাসিক ব্যক্তি - যিনি নির্ভরযোগ্য নন তিনি খলীফা হতে পারবেন না। খলীফা নিয়োগ ও এর ধারাবাহিকতার জন্য সততা একটি আবশ্যিক গুণ। আল্লাহ্‌ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেছেন, সাক্ষ্যদানকারী গন অবশ্যই ন্যায়পরায়ণ হবেন। তিনি (সুবহানাহু ওয়া তা'আলা) বলেন:

 

"আর এমন দু'জন লোককে সাক্ষী বানাবে যারা তোমাদের মাঝে সুবিচারবাদী হবে।" [সূরা আত-তালাক: ২]

 

যেহেতু সাক্ষ্য দানকারীদের সততার কথা বলা হয়েছে সেহেতু যিনি ঐসব সাক্ষ্য দানকারীর শাসক ও উচ্চপদস্থ হবেন তাকে তো অবশ্যই সৎ হতে হবে।

 

ষষ্ঠত: খলীফা অবশ্যই আযাদ বা মুক্ত হবেন।

 

যেহেতু একজন দাস তার ব্যাপারে স্বাধীন নয়, সে তার প্রভূর নিয়ন্ত্রনাধীন, সেহেতু জনগণের বিষয়াবলী দেখা ও তাদের শাসন করা তার পক্ষে সম্ভবপর নয়।

 

সপ্তমত: খিলাফতের দায়িত্ব পালনে খলীফাকে অবশ্যই পারঙ্গম হতে হবে।

 

কারণ এটি বাই'য়াতের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। যে ব্যক্তি দায়িত্ব পালনে অক্ষম সে কীভাবে বাই'য়াত অনুসারে মানুষের সমস্যাবলী নিরসন করবে এবং আল্লাহ্‌'র কিতাব ও রাসূল (সা:) এর সুন্নাহ্‌ দিয়ে শাসন করবে? মাযালিম আদালত (The Court of Unjust Act) এর ক্ষমতা রয়েছে একজন খলীফার কী ধরণের অযোগ্যতা থাকতে পারবে না সে বিষয়সমূহ নির্ধারণ করবার।

 

পছন্দনীয় শর্তাবলী:

 

উপরে উল্লেখিত শর্তাবলী একজন খলীফা নিযুক্ত হবার জন্য আবশ্যিক গুনাবলী। এ সাতটি বাদে বাকী কোন শর্তই খলীফা নিযুক্ত হবার জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আর কিছু শর্তাবলী রয়েছে যেগুলো সহীহ দলিল প্রমাণের মাধ্যমে যদি জরুরী প্রমাণিত হয় তাহলে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এগুলো গ্রহণ করা যেতে পারে, তবে সেগুলো হবে পছন্দনীয় শর্তাবলী। যদি কোন নির্দেশ অকাট্য (Decisive) বলে প্রমাণিত হয় তাহলে সেটাকে আবশ্যিক শর্তাবলীর আওতায় নেয়া হবে। আর যদি দলিলের ভিত্তিতে সেটি অকাট্য বা চূড়ান্ত (Decisive) বলে প্রমাণিত না হয় তাহলে সে শর্তটি পছন্দনীয় বলে পরিগণিত হবে। এখন পর্যন্ত উল্লেখিত সাতটি আবশ্যিক শর্তাবলী ব্যতীত দলিল প্রমাণের ভিত্তিতে আর কোন গুনাবলী আবশ্যিক বলে পরিগণিত হয়নি। সে কারণে এই সাতটিই খলীফা নিয়োগের জন্য আবশ্যিক শর্তাবলী হিসেবে বিবেচিত। পছন্দনীয় শর্তাবলীর মধ্যে রয়েছে, যেমন:খলীফা হবেন কুরাই', মুজতাহিদ কিংবা অস্ত্র চালনায় পারদর্শী - যেগুলোর ব্যাপারে অকাট্য দলিল নেই।
চলবে--------------

 
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free