Let your mind to be opened to explore the truth
This is my way (ISLAM); I invite to Allah with insight :12-No Sura Yousuf: Verse-108.”

খিলাফাহ ও আমরা মুসলিম জাতি -প্রথম অধ্যায়

 

শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত রাসুলুল্লাহ (সা) এর বক্তব্যসমুহ ও এর ব্যাখ্যা পর্ব-১

 

 

ইসলামী শাসন

খলিফাগণই মুসলিম উম্মাহর শাসক

 

হাদিস-১

 

كانَتْ بَنُوِإسْرَائِي َ ل تَسُوسُهُمُ الأَنِبيَاءُ ُ كلَّمَا هَلكَ نِبىٌّ خَلَفهُ نِبىّ

وِإنَّهُ َ لا نِبىَّ بَعْدِى وَسَتَكُو ُ ن خُلَفَاءُ يَكُثرُو َ ن َقاُلوا َفمَا تْأمُرُنَا قَا َ لُفوا ِببَيْعَةِ الأَوَّ ِ ل فَالأَوَّ ِ ل وَأعْ ُ طوهُمْ حَقَّهُمْ فِإنَّ اللَّهَ سَائِلُهُمْ عَمَّ ِ ن

اسْتَرْعَاهُمْ

বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখনই কোনও একজন নবী মৃত্যুবরণ করতেন, তখনই অন্য একজন নবী তার স্থলাভিষিক্ত হতেন, আর আমার পরে কোনও নবী আসবেন না, আসবেন খলিফাগণ এবং তারা হবেন সংখ্যায় অনেক।

সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন-তখন আপনি আমাদেরকে কি আদেশ করছেন? রসুল (সা) উত্তরে বললেন-একের পর এক তাদের প্রতি তোমাদের বাইয়াত (আনুগত্যের শপথ) পূর্ণ কর এবং তাদের অধিকার পূর্ণ কর। আর নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা তাদেরকে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন।” (বুখারী ও মুসলিম)

 

ব্যাখাঃ

১। এখানে تسوسھم তাসুসুহুম (দৈনন্দিন বিষয়াদি দেখাশুনা করা) শব্দটি নির্দেশ করছে যে, রাসুল (সা) এর পূর্বের নবীগণও তাদের প্রতি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার পক্ষ থেকে নাযিলকৃত বিধান দ্বারা তাদের অনুসারীদের শাসন করতেন এবং দৈনন্দিন বিষয়াদি দেখাশুনা করতেন।

 

২। খুলাফাহ শব্দটি শব্দটি খলীফা শব্দের বহুবচন এবং হাদিসে ব্যবহৃত يكثرون ইয়াকছিরুন’ (তারা সংখ্যায় অনেক হবে) দ্বারা বুঝানো হচ্ছে যে, রাসুল (সা) এর মৃত্যুর পর অনেক খলীফা আসবেন, আর এটা শুধুমাত্র চার খলীফার সময়েই খিলাফত বিদ্যমান ছিল এই দাবীর পরিপন্থী।

 

৩। খিলাফতের দ্বায়িত্বকাল ৩০ বছর বলে উল্লেখ করে একটি বর্ণনা রয়েছে এবং ইবনে তাইমিয়ার বর্ণনা অনুযায়ী প্রথম ৩০ বছর খিলাফত রসূল (সা) এর পন্থা ও সুন্নাতের উপর পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তবে ঐ হাদিসটি দ্বারা খিলাফতের সময়কালের ব্যাপারে কোনও সুনির্দিষ্ট সময়কাল নির্ধারণ করে দেওয়া হয় নি। আর তাই খিলাফত মাত্র ৩০ বছর কাল স্থায়ী ছিল তা বলা যৌক্তিক নয়।

 

৪। ইমাম নববীর মতে একের পর এক তাদের প্রতি তোমাদের আনুগত্যের শপথ (বাইয়াত) পূর্ণ করএই বাক্যের মাধ্যমে বোঝানো হচ্ছে যে, একই সময়ে শুধুমাত্র একজন খলীফা থাকায় অনুমোদিত এবং একজন খলীফা বিদ্যমান থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে বাইয়াত দেয়া সম্পূর্ণ অবৈধ (হারাম)।

 

খিলাফত পুনঃপ্রতিষ্ঠার রসুল (সা) এর ভবিষ্যতবাণী

 

হাদিস-২

 

تكون النبوة فيكم ما شاء الله أن تكون ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها ثم تكون خلافة على

منهاج النبوة فتكون ما شاء الله أن تكون ثم يرفعها إذا شاء الله أن يرفعها ثم تكون ملكا

عاضا فيكون ما شاء الله أن يكون ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها ثم تكون ملكا جبرية

فتكون ما شاء الله أن تكون ثم يرفعها إذا شاء أن يرفعها ثم تكون خلافة على منهاج

النبوة

 

তোমাদের মধ্যে নবুয়্যত থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ্ ইচ্ছা করেন, তারপর আল্লাহ তার সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে নবুয়্যতের আদলে খিলাফত। তা তোমাদের মধ্যে থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করবেন অতঃপর তিনি তারও সমাপ্তি ঘটাবেন। তারপর আসবে যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন তা থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করেন। এক সময় আল্লাহর ইচ্ছায় এরও শেষ হবে। তারপর প্রতিষ্ঠিত হবে জুলুমের শাসন এবং তা তোমাদের উপর থাকবে যতক্ষণ আল্লাহ ইচ্ছা করবেন। তারপর তিনি তা অপসারণ করবেন। তারপর আবার ফিরে আসবে খিলাফত নবুয়্যতের আদলে।এরপর তিনি (সাঃ) নীরব থাকলেন।” (মুসনাদে আহমদ)

 

ব্যাখাঃ

১। এই হাদিস থেকে রসুল (সা) এর মৃত্যুর পর নবুয়্যত ও খিলাফতের শাসনকার্যের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য থাকবে না এই দৃষ্টিকোণ থেকে যে, খিলাফত একমাত্র তার (সা) প্রদর্শিত পথ ও পদ্ধতির উপরই অধিষ্ঠিত থাকবে এবং তার (সা) এর পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। সুতরাং ইসলামী শারিআহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নবুয়্যত ও খিলাফতের পদ্ধতিগত সামঞ্জস্য বা মিল রয়েছে। শুধুমাত্র যে পার্থক্যটি রয়েছে তা হল রসুল (সা) এর মৃত্যুর পূর্বেই ওহী অবতরণ পূর্ণ হয়ে গেছে।

 

২। যন্ত্রণাদায়ক বংশের শাসন বলতে বাইয়াত গ্রহণের অপব্যবহারকে বোঝানো হয়েছে যা রসুল (সা) ও চার খলীফা (রা) র সময়ে যেরূপ সন্তুষ্টচিত্তে বাইয়াত গ্রহণ করা হত তার পরিবর্তে তখন উত্তরাধিকার সূত্রে বাইয়াত হস্তান্তর করা হত।

 

৩। আর জুলুমের শাসন হল সেই শাসন যখন মুসলমানগণ ইসলাম দিয়েই শাসিত হচ্ছিল কিন্তু শাসকবৃন্দ জনগণের উপর অত্যাচার করত। যেমন অন্যত্র রসুল (সা) এর এক বর্ণনায় পাওয়া যায় যে মুসলমানদের তাদের শাসকদের অত্যাচার সত্ত্বেও তাদের আনুগত্য করা উচিত যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা পাপ কাজের আদেশ করে। এবং বর্তমান সময়ের শাসন যেখানে মুসলিমরা ইসলাম পরিপন্থী তথা কুফুরী শাসন ব্যবস্থা ও জালেম শাসকদের শাসিত হচ্ছে।

 

৪। হাদিসের শেষ অংশটি মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি সুসংবাদ ও ভবিষ্যৎ বাণী যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার ইচ্ছা অনুযায়ী খিলাফত আবার নবুয়্যতের আদলে প্রতিষ্ঠিত হবে।

 

খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরয

 

হাদিস-৩

 

مَنْ خَلعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ َلقِىَ اللَّهَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَ َ لا حُجَّة َلهُ وَمَنْ مَاتَ

وَليْسَ فِى عُنُقِهِ بَيْعٌة مَاتَ مِيتًة جَاهِلِيًّ

 

যে ব্যাক্তি আমীরের আনুগত্য থেকে তার হাত সরিয়ে নিল, কেয়ামতের দিন সে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার সাথে এমনভাবে মিলিত হবে যে, তার স্বপক্ষে কোনরূপ প্রমাণ থাকবে না। আর যে ব্যাক্তি এমনাবস্থায় মৃত্যুবরণ করল যে, তার কাঁধে আনুগত্যের শপথ নেই তবে সে জাহিলিয়াতের মৃত্যুবরণ করল।” (মুসলিম)

 

হাদিস-৪

من خرج من الجماعة قيد شبر فقد خلع ربقة الإسلام من عنقه

حتى يراجعه من مات و ليس عليه إمام جماعة فإن موتته موتة

جاهلية

 

যে ব্যাক্তি জামাত (ঐক্যবদ্ধ মুসলিম উম্মাহ) থেকে নিজেকে এক বিঘত পরিমাণ সরিয়ে নিল তবে সে যেন তার কাঁধ থেকে ইসলামকে সরিয়ে ফেলল যতক্ষণ পর্যন্ত না সে আবার ফিরে আসে। আর যে ব্যাক্তি এমনাবস্থায় মৃত্যুবরণ করল যে, তার উপর (মুসলিম উম্মাহর) কোন আমীর নেই তবে তার মৃত্যু জাহিলিয়াতের মৃত্যু। (হাকিম)

 

ব্যাখাঃ

১। উপরোক্ত হাদিসগুলোতে দেখা যাচ্ছে যে, সত্যের (ইসলাম) উপর ঐক্যবদ্ধ হওয়া ফরজ। এক বিঘত বলতে বোঝানো হচ্ছে যে, মুসলমানদের মধ্যে ছোট বড় যেকোনও ধরণের অনৈক্য বা ভাঙ্গন হারামবা অবৈধ।

 

২। ইসলাম বৈধ বা অনুমোদিত শাসকের প্রতি আনুগত্যকে ফরজ করেছে। পাশাপাশি এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে যে অন্যান্য হাদিসে কখন শাসকের বিরোধিতা এমনকি বিদ্রোহ করা যাবে তার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করা হয়েছে। (যেমনঃ যখন শাসক আল্লাহর প্রণীত ইসলাম ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করে।)

 

৩। হাদিসে উল্লেখিত আনুগত্যের শপথ বাইয়াত বলতে শাসক ও উম্মাহর মধ্যে গৃহীত বাইয়াতকে বোঝানো হয়েছে। যেমন রসুল (সা) তার পরবর্তী সাহাবী (রা) দের ক্ষেত্রে দেখা যায় জনগণকে কুরআন সুন্নাহ দিয়ে শাসন করার নিমিত্তে আই বাইয়াত দেয়া হত।

 

৪। হাদিসে উল্লেখিত জাহিলিয়াতের মৃত্যুহল একটি ইঙ্গিত যে কাঁধে আনুগত্যের শপথ ছাড়া মৃত্যুবরণ করা হারাম। ফলে আনুগত্যের শপথ থাকাটা বাধ্যতামূলক একইভাবে খলীফা থাকাটাও ফরজ কেননা খলিফাকেই বাইয়াত প্রদান করতে হবে। ইমাম তাফতাজানী ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ (তার ইযালাতুল খাফা আন খিলাফাতুল খুলাফা গ্রন্থে) এই মত ব্যক্ত করেন।

 

৫। দ্বিতীয় হাদিসে তার উপর মুসলিম উম্মাহর শাসক না থাকাদ্বারা প্রথম হাদিসে উল্লেখিত তার কাঁধে আনুগত্যের শপথএই বাক্যাংশের স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।

 

৬। ইসলামী শরীয়াহর মূলনীতি ওয়াজিব পালনের জন্য যা প্রয়োজন তা নিজেই ওয়াজিবএই নীতির আলোকে খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরয। তা এমন এক হুকুম যা সকল মানুষের জন্য প্রযোজ্য কেননা من ” ‘মান’ (যে কেউ) শব্দটি দ্বারা সাধারণভাবে সবাইকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

 

খলীফা একজন হওয়া ফরজ

 

হাদিস-৫

إَذا بُوِيعَ لِخَلِيَفتَيْ ِ ن فَاقْتُلوا الآخِرَ مِنْهُمَا

 

যখন দুইজন খলীফাকে বাইয়াত দেয়া হয় তখন দ্বিতীয়জনকে হত্যা কর। (মুসলিম)

 

১। সাহাবীদের ইজমার (ঐক্যমত) ভিত্তিতে এটা প্রমাণিত যে, কোনও নির্দিষ্ট সময়ে মুসলমানদের জন্য দুজন খলীফা থাকা জায়েজ নেই। ইমাম নববী একে ইজমা হিসেবে প্রমাণ করেন এবং উপরোক্ত হাদিস দ্বারাও তা প্রমাণিত।

 

২। হাদিসে প্রদত্ত দ্বিতীয় খলীফাকে হত্যার আদেশটি নির্দেশ করে যে, দ্বিতীয় খলীফাকে অপসারণ করার জন্য অন্য সকল পথ অকার্যকর হয়েছে।

 

৩। যদিও এটা সর্বজন বিদিত যে, একজন মুসলমানের রক্ত পবিত্র তথাপি দুইজন খলীফার দ্বিতীয়জনকে হত্যার আদেশটি মূলত মুসলমানদের এককেন্দ্রিক শাসনের বাধ্যবাধকতারই প্রবল ইঙ্গিত বহন করে এবং অস্তিত্ব রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।

 

শাসন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র পরিচালনা সম্পর্কিত রাসুলুল্লাহ (সা) এর বক্তব্যসমুহ ও এর ব্যাখ্যা পর্ব-২

ইসলামী রাষ্ট্র ও তার সম্প্রসারণের ভিত্তি হলো ইসলামী আকীদাহ্

 

হাদীস-৬

জুনাদাহ ইবনে আবু উমাইয়া থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন - আমরা উবাদা বিন সামিতের নিকট গমন করলাম, তখন তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং আমরা তাঁকে বললাম আল্লাহ্ আপনাকে সুস্থতা দান করুন। আমাদেরকে রাসূল (সাঃ) এর পক্ষ থেকে এমন কোন হাদীস বর্ণনা করুন যা দ্বারা আল্লাহ্ আমাদের উপকার করতে পারেন। তিনি বললেন - রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে ডাকলেন এবং আমরা তাঁকে বাইআত প্রদান করলাম। তিনি যে সকল অঙ্গিকারগুলো আমাদের উপর বাধ্যতামূলক করেছেন সেগুলো হলো - আমাদের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি, সংকট ও সমৃদ্ধি, এমনকি আমাদের উপর যদি অন্য কাউকে প্রাধান্য দেয়া হয় তবুও সর্বাবস্থায় আমীরের নির্দেশ শ্রবণ করব ও তার আনুগত্য করব এবং ক্ষমতার ব্যাপারে আমরা তাদের সাথে বিবাদ করব না (সর্বাবস্থায়ই তাদের প্রতি আনুগত্য থাকবে)। তিনি (সাঃ) বলেন, “কিন্তু তোমরা যদি তাদের মধ্যে আল্লাহ্ কর্তৃক প্রমাণিত স্পষ্ট কুফর দেখতে পাও তবে নয়।” [মুসলিম]

 

হাদীস-৭

রাসূল (সাঃ) বলেছেন - আমাকে মানুষের সাথে যুদ্ধ করতে আদেশ দেয়া হয়েছে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না তারা এই সাক্ষ্য প্রদান করে যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ্ নেই আর মুহাম্মদ আল্লাহ্র রাসূল আর তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে ও যাকাত আদায় করে। [বুখারী ও মুসলিম]

 

ব্যাখ্যা:

ক. ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে ইসলামী আকীদাহ্ ছাড়া অন্য কিছু থাকা জায়েয নাই। সূতরাং রাষ্ট্রের সংবিধান ও আইন কানুন অবশ্যই শারীআহ্ থেকে গ্রহণ করা হবে।

 

খ. প্রথমোক্ত হাদীসটি এর প্রমাণ বহণ করে কেননা এতে বলা হয়েছে যে, ইসলামী আকীদাহ্ থেকে বিচ্যুত হওয়াই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণ করার একমাত্র বৈধ কারণ। অন্যকথায় ইসলামী আকীদাহ্ থেকে উদ্ভুত হয়নি এমন কোন আইন বাস্তবায়ন করলে রাষ্ট্রের কর্তৃত্বের কোন বৈধতা থাকবেনা।

 

গ. এরূপ অন্যান্য হাদীসেও শাসকের বিরুদ্ধে তরবারী উত্তোলন করতে নিষেধ করা হয়েছে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, স্পষ্ট কুফুরী না করে অথবা আল্লাহ্র বিরুদ্ধে প্রকাশ্য পাপ না করে। মোটকথা হলো শুধুমাত্র ইসলাম বাস্তবায়ন করাই শাসকের কর্তৃত্বের বৈধতার উৎস; অন্য কিছু নয়।

 

ঘ. ইমাম নববীর মতে, স্পষ্ট কুফর হলো প্রকাশ্য পাপ কাজ যা শারীআহ্র দলিল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত।

 

ঙ. শাসককে অপসারণ করা কখন ফরয হয় এ ব্যাপারে ইমামদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কাজী ইয়াদের মতে, যখন কুফরী সাধন, শারীআহ্ আইনের পরিবর্তন এবং নতুন মনগড়া আইন উদ্ভাবনের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় তখন মুসলিমদের জন্য সেই শাসককে অপসারণ করে তদস্থলে অন্য একজন ন্যায়পরায়ণ শাসক প্রতিষ্ঠা করা ফরয হয়ে যায়।

 

চ. এটা লক্ষ্যণীয় যে, এই সকল হাদীস শুধু অত্যাচারী শাসকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যে মূলতঃ বৈধ শাসক ছিল কিন্তু পরবর্তীতে সে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে উঠে অথবা শাসন ব্যবস্থা ইসলাম অনুযায়ী পরিচালিত কিন্তু শুধু শাসকের সংশোধন প্রয়োজন। অন্যকথায় এই হাদীসগুলো ইসলামী রাষ্ট্রের সেই শাসকবৃন্দের সংশোধনের সাথে সংশ্লিষ্ট যারা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমান যুগের শাসকবৃন্দ কখনোই ইসলামের ভিত্তিতে শাসনকার্য পরিচালনা করেনি এবং তাদের শাসন ব্যবস্থা পুরোটাই অনৈসলামিক।

 

ছ. দ্বিতীয় হাদীসের মতে, শুধু ইসলামী আকীদাহ্ই শাসন কর্তৃত্ব ও সরকারের ভিত্তি হবে তা নয় বরং রাসূল (সাঃ) জিহাদকে ফরয করেছেন এবং এই আকীদাহ্ (ইসলাম) মানুষের নিকট পৌঁছে দেয়ার জন্য জিহাদকে সকল মুসলিমের উপর ফরয করেছেন।

 

আইনের উৎস

 

হাদীস-৮

রাসূল (সাঃ) হযরত মুয়ায (রাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “যদি তোমার নিকট কোন একটি বিষয় আনয়ন করা হয় তখন তুমি কিভাবে তার সমাধান করবে?” হযরত মুয়ায (রা.) বলেন, “আমি আল্লাহ্র কিতাব (কুরআন) দিয়ে বিচার করব।রাসূল (সাঃ) বললেন, “যদি তুমি আল্লাহ্র কিতাবে এর সমাধান না পাও তাহলে?” মুয়ায (রা.) উত্তরে বললেন, “তাহলে আল্লাহ্র রাসূল (সাঃ) এর সুন্নাহ (হাদীস) দ্বারা বিচার ফয়সালা করব।রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন, “যদি তুমি সুন্নাহ্ কিংবা আল্লাহ্র কিতাবে তার সমাধান না পাও তাহলে?” উত্তরে মুয়ায (রা.) বললেন যে, তিনি তখন তাঁর নিজস্ব বিচার-বিবেচনা ব্যবহার করবেন (অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহ্র আলোকে ইজতিহাদ করবেন)। [আবু দাউদ, আহমদ]

 

ব্যাখ্যা:

ক. মুসলিমদের হেদায়েত ও আইন প্রণয়নের প্রধান দুইটি উৎস হলো কুরআন ও সুন্নাহ্ (সহীহ হাদীস) - এখানে তা নিশ্চিত করা হয়েছে।

 

খ. যদি কোন বিশেষ ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসে সরাসরি স্পষ্ট বর্ণনা না থাকে তাহলে মুজতাহিদদের জন্য ইজতিহাদের প্রক্রিয়া হলো তারা যে বিষয়ের সম্মুখীন হয়েছে সে ব্যাপারে শারীআহ্র হুকুম বের করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা।

 

গ. আহলে সুন্নাহ্ কর্তৃক গৃহীত শারীআহ্র চারটি মূলনীতি হলো কুরআন, সুন্নাহ্ (হাদীস), ইজমা (সাহাবীদের ঐক্যমত), এবং কিয়াস।

 

ইসলাম হুকুমগুলো নির্ধারণ করে, কৌশলগত (Styles and Techniques) বিষয়াদি নয়

 

হাদীস-৯

মুসা বিন তালহা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন - আমি রাসূল (সাঃ) এর সাথে খেজুর গাছের নিকটবর্তী কিছু লোকের পাশ দিয়ে গেলাম। তিনি (সাঃ) বললেন, “এই লোকগুলো কি করছে?” তারা বলল, “তারা গাছের কলম করছে (তারা পুরুষ ও স্ত্রী গাছকে একত্রে রোপণ করে এবং আশা করে যে, অধিক ফলন হবে)।তারপর রাসূল (সাঃ) বলেন, “আমার মনে হয় এটা কোন কাজে আসবে না।যখন লোকগুলো তা জানতে পারলো তখন তারা তা পরিত্যাগ করলো। পরবর্তীতে রাসূল (সাঃ) যখন বিষয়টি জানতে পারলেন তখন তিনি (সাঃ) বললেন, “যদি এতে (গাছের মিলনে) তাদের কোন উপকার হয় তবে তাদের তা করা উচিৎ। এটা শুধু আমার নিজস্ব একটি মতামত ছিল। তোমরা আমার নিজস্ব মতামত গ্রহণ করো না। কিন্তু যখন আমি তোমাদেরকে আল্লাহ্র পক্ষ থেকে কিছু বলি তবে অবশ্যই তোমরা তা গ্রহণ করবে। কেননা আমি কখনোও সুমহান, মহিমান্বিত আল্লাহ্র উপর মিথ্যারোপ করিনা।” [মুসলিম]

 

হাদীস -১০

হযরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সাঃ) কিছু সংখ্যক লোকের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন যখন তারা গাছ কলম করছিল। তখন তিনি (সাঃ) বলেন, “যদি তোমরা কলম না করতে তাহলে তাই তোমাদের জন্য মঙ্গলজনক হতো।” (ফলে তারা তা বর্জন করে) এতে তাদের ফলন খারাপ হলো। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাদের পাশ দিয়ে অতিক্রম করলেন এবং বললেন, “তোমাদের খেজুর গাছের এই খারাপ অবস্থা কেন?” তারা বলল, “আপনি আমাদেরকে এরূপ করতে বলেছেন।তখন তিনি (সাঃ) বলেন, “তোমরাই পার্থিব বিষয়াদি সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখ।” [মুসলিম]

 

ব্যাখ্যা:

ক. কতিপয় আধুনিকপন্থী লোক এরূপ হাদীসগুলোর উদ্ধৃতি দিয়ে দাবী করে যে - মানুষের দৈনন্দিন জীবন পরিচালনার জন্য ইসলাম কোনরূপ বিধান দেয়নি। এটা এই হাদীসগুলোর সম্পূর্ণ অপব্যাখ্যা কেননা ইমাম নববী তার সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যাগ্রন্থে বলেন, “আলেমগণ বলেন, রাসূল (সাঃ) এর বাণী আমার নিজস্ব মতামতবলতে বুঝায় দুনিয়া ও জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদনের ধরন (Style) সংক্রান্ত বিষয়সমূহ, আইন সংক্রান্ত বিষয় নয়। কিন্তু আইন সংক্রান্ত বিষয় এবং তিনি যা শারীআহ্ ও ইজতিহাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বলেছেন তা গ্রহণ করা ফরয। খেজুর গাছের পরাগায়ন এই ধরনের হুকুমের অন্তর্ভূক্ত নয় অর্থাৎ এটি দুনিয়া ও জীবিকার সাথে সংশ্লিষ্ট কাজ সম্পাদনের ধরন (Style) সংক্রান্ত বিষয়।

 

খ. আমাদের কাজ সম্পাদনের ধরন (Style) ও খুঁটিনাটি বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য শারীআহ্ আসেনি বরং শারীআহ্ এসেছে হালাল-হারাম, বৈধ-নিষিদ্ধ বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করতে। কোন কাজ সম্পাদনের ধরন সাধারণত ঐ নির্দিষ্ট কাজের নীতিমালার মধ্যেই নিহিত থাকে; ফলে কোন কাজ বৈধ বলেই নির্দেশ দেয়া হতে পারে, যেমন- চাষাবাদ। কিন্তু সময় ও নির্দিষ্ট অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কাজের ধরন ভিন্ন হতে পারে, যেমন - সেচ ব্যবস্থা প্রয়োগ বা জমির উর্বরতার সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য পর্যায়ক্রমে শস্য উৎপাদন।

 

গ. এই হাদীসগুলো মূলতঃ খেজুর গাছের পরাগায়ন সংক্রান্ত। ফলে এগুলো কৃষি ও শিল্প ক্ষেত্রে উদ্ভুত অনুরূপ পরিস্থিতির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

 

ঘ. প্রথম হাদীসে উল্লেখিত ঘটনায় রাসূল (সাঃ) বলেন, এটা ছিল রাসূল (সাঃ) এর শুধু একটি ধারণা মাত্র। এটা আইন সংক্রান্ত কোন বিষয় নয় বরং তা ছিল কৌশলগত (Styles and Techniques) বিষয়ে রাসূল (সাঃ) এর একটি মতামত। একইভাবে বদর যুদ্ধের দিন সেনাবাহিনীর অবস্থান নির্ধারণে রাসূল (সাঃ) এর সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আল হুবাব বিন মুনযির (রা.) জিজ্ঞাসা করেন, সিদ্ধান্তটি কি রাসূল (সাঃ) এর কৌশলগত মতামত নাকি আল্লাহ্র পক্ষ থেকে ওহী, অর্থাৎ যদি এটা তাঁর নিকট অবতীর্ণ ওহী হয় তাহলে এ ব্যাপারে কোন আলোচনার অবকাশ নেই কিন্তু যদি তা কৌশলগত বিষয়ে রাসূল (সাঃ) এর নিজস্ব কোন মতামত হয় তবে তা বিকল্প কোন স্থানে হতে পারে যা সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে অধিকতর কৌশলগত অবস্থান হবে।


খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা ফরয

 

যে রাষ্ট্রব্যবস্থা আহকামে শারিআহ্র প্রয়োগ ও ইসলাম প্রচারের জন্য দায়িত্বশীল তাই হচ্ছে খিলাফত। ইসলামী শাসনব্যবস্থাকেই খিলাফত নামে অভিহিত করা হয়। সারাবিশ্বের মুসলমানদের উপর খিলাফত প্রতিষ্ঠা করা একটি অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার আদেশকৃত অন্যান্য ফরয কাজের মত খিলাফত প্রতিষ্ঠার ফরয কাজটাও অবশ্যই আমাদেরকে পালন করতে হবে। এ ব্যাপারে কোনও পছন্দ-অপছন্দ, ইচ্ছা-অনিচ্ছার সুযোগ নেই। এই দায়িত্বের প্রতি উদাসীন থাকা কিংবা একে উপেক্ষা করা একটি কবিরা গুনাহ যার জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা শাস্তি দেবেন। এই বিষয়টি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কিতাব, রাসুল (সা) এর সুন্নাহ ও সাহাবা (রা) দের ইজমা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং শ্রেষ্ঠতম আলেমদের বক্তব্যে সুস্পষ্ট।

 

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালার কিতাব থেকে প্রমাণঃ

আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) রাসূল (সাঃ) কে মুসলমানদের পারস্পরিক বিষয়সমূহ তিনি যা নাজিল করেছেন সে অনুযায়ী সম্পন্ন করতে বলেছেন; অত্যন্ত সুষ্পষ্টভাবে তিনি (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) তাঁকে (সাঃ) এই আদেশ দিয়েছেন।

 

আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) রাসূল (সাঃ) কে বলেন,

 

فَاحْكُم بَيْنَهُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ وَلاَ تَتَّبِعْ أَهْوَاءهُمْ عَمَّا جَاءكَ مِنَ الْحَقِّ

 

অতএব, আপনি তাদের পারস্পরিক ব্যাপারাদিগকে আল্লাহ্ যা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদানুযায়ী ফয়সালা করুন এবং আপনার কাছে যে সৎপথ আসিয়াছে, তাহা পরিত্যাগ করিয়া তাহাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করিবেন না ......।” [সূরা আল-মায়িদাহ্: ৪৮]

 

وَأَنِ احْكُم بَيْنَهُم بِمَآ أَنزَلَ اللّهُ وَلاَ تَتَّبِعْ أَهْوَاءهُمْ وَاحْذَرْهُمْ أَن يَفْتِنُوكَ عَن بَعْضِ مَا أَنزَلَ اللّهُ إِلَيْكَ

 

আর আমি আদেশ দিতেছি যে, আপনি ইহাদের পারস্পরিক ব্যাপারে এই প্রেরিত কিতাব অনুযায়ী মীমাংসা করিবেন এবং তাহাদের প্রবৃত্তি অনুযায়ী কাজ করিবেন না এবং তাহাদিগ হইতে অর্থাৎ এ বিষয়ে সতর্ক থাকিবেন যেন তাহারা আপনাকে আল্লাহর প্রেরিত কোনও নির্দেশ হইতে বিভ্রান্ত করিতে না পারে।” [সূরা আল-মায়িদাহ্: ৪৯]

 

রাসূল (সাঃ) এর প্রতি আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা)র আদেশ তাঁর (সাঃ) উম্মাহ্র প্রতিও সমভাবে প্রযোজ্য যতক্ষণ না সেখানে কোনও স্পষ্ট প্রমাণ থাকে যে উক্ত উক্তি শুধু তাঁর (সাঃ) প্রতি সীমাবদ্ধ। এক্ষেত্রে আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা)র উপরোক্ত উক্তিগুলোতে এমন প্রমাণ নেই যে এগুলো শুধু রাসূল (সাঃ) এর প্রতি সীমাবদ্ধ। এভাবে উক্ত আয়াতগুলোতে মুসলমানদেরকে আল্লাহর আইন বাস্তবায়নের আদেশ দেয়া হয়েছে। আর একজন খলিফার নিয়োগ আসলে আল্লাহর আইন ও ইসলামিক ক্ষমতার বাস্তবায়নকেই বোঝায়। আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) মুসলমানদেরকে ক্ষমতার বাহক শাসকদেরকে মেনে চলতেও বাধ্য করেছেন আর শাসককে মেনে চলার জন্য শাসকের (খলিফা) বর্তমান থাকা আবশ্যক।

 

আল্লাহ্ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) বলেন,

 

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ أَطِيعُواْ اللّهَ وَأَطِيعُواْ الرَّسُولَ وَأُوْلِي الأَمْرِ مِنكُمْ فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلاً

 

হে ঈমানদারগণ; আল্লাহ্র নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রাসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা কর্তৃত্বশীল তাদের; অনন্তর যদি তোমরা কোনও বিষয়ে পরষ্পর দ্বিমত হও, তবে ঐ বিষয়কে আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের উপর ছাড়িয়া দাও, যদি তোমরা আল্লাহর প্রতি এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি ঈমান রাখ।’’ [সূরা আল-নিসা: ৫৯]

 

যে বাস্তবে অস্তিত্বশীল নয় আল্লাহ তার আনুগত্যের আদেশ দেন না। সুতরাং একজন শাসকের বর্তমান থাকা বাধ্যতামূলক এবং যারা ক্ষমতায় আছে তাদের আদেশ মানার আদেশ সেই ক্ষমতাশীলদের প্রতিষ্ঠা করার আদেশেরই নামান্তর। শরিয়াহ্ আইনের বাস্তবায়ন একজন ক্ষমতাশীলের উপস্থিতির উপর নির্ভরশীল এবং সেই শাসকের অনুপস্থিতির ফলস্বরূপ শরিয়াহ্ আইন অবাস্তবায়িত থাকে। যেহেতু একজন শাসকের অনুপস্থিতি শরিয়াহ্ আইনকে অবাস্তবায়িত রাখে (যা গুনাহ্) সুতরাং সেই শাসকের উপস্থিতি একটা ফরজ বিষয়।

 

সুন্নাহ্ ভিত্তিক দলিল-প্রমাণঃ

আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) থেকে বলতে শুনেছি, ‘যে আনুগত্যের শপথ (বায়াত) থেকে তার হাত ফিরিয়ে নেয়, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তার সাথে এমনভাবে সাক্ষাত করবেন যে ঐ ব্যক্তির পক্ষে কোনও দলিল থাকবে না, এবং যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে যে তার কাঁধে কোনও আনুগত্যের শপথ নেই তবে তার মৃত্যু হচ্ছে জাহেলী যুগের মৃত্যু।’”  [মুসলিম]

 

এভাবে রাসূল (সাঃ) প্রত্যেক মুসলমানের উপর আনুগত্যের শপথ (বায়াত) থাকাকে ফরজ বলে নির্দেশ করে গিয়েছেন। যে বায়াত (আনুগত্যের শপথ) ছাড়া মৃত্যু বরণ করে তিনি (সাঃ) তার মৃত্যুকে ইসলামপূর্ব অজ্ঞানতার (জাহেলিয়াতের) যুগের মৃত্যু হিসাবে বর্ণনা করেছেন। আর এটাও স্পষ্ট যে আনুগত্যের শপথ দেওয়ার জন্য একজন খলিফা (ইমাম) থাকা জরুরী।

 

যদিও রাসূল (সাঃ) উল্লেখ করেননি যে প্রত্যেক মুসলমানের জন্যই খলিফার হাতে আনুগত্যের শপথ করা একটা ফরজ কাজ তথাপি তিনি (সাঃ) সব মুসলমানের কাঁধের উপর আনুগত্যের শপথ থাকাকে অবশ্য কর্তব্য করে দিয়েছেন। অন্য কথায় প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের উপর একটা আনুগতযে র শপথ (বায়াত) থাকা ফরজ। এটা মুসলমানদের মধ্যে এমন একজন খলিফা থাকাকে অবশ্য প্রয়োজনীয় করে তোলে যার কাছে আনুগত্যের শপথ করা যায়। সমভাবে খলিফার উপস্থিতিই প্রত্যেক মুসলমানের কাঁধের  উপর আনুগত্যের শপথকে (বায়াত) সম্ভব করে।

 

হিশাম বিন উরওয়া আবি সালেহ্ থেকে, আবি সালেহ্ আবু হোরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘আমার পরে যে নেতারা ক্ষমতা গ্রহণ করবে তাদের ভেতর ধর্মপরায়নরা তোমাদেরকে তাদের ধার্মিকতা দিয়ে পরিচালিত করবে এবং অধার্মিকরা তাদের অধার্মিকতা দিয়ে। অতএব তাদের কথা শোনো ও তাদেরকে মান্য কর এমন সব ক্ষেত্রে যেখানে তারা সত্যের অনুগামী হয়। যদি তারা সঠিকভাবে কাজ করে তবে তা তোমাদের পক্ষে যাবে, এবং যদি তারা ভুলভাবে কাজ করে তবে তা তোমাদের পক্ষে ও তাদের বিরুদ্ধে হিসাব করা হবে।  [আল-মাওয়ার্দি]

 

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে আল-আরাজ ও সেই সূত্রে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “নিশ্চয়ই, ইমাম হচ্ছেন ঢাল স্বরূপ যার পেছনে থেকে জনগণ যুদ্ধ করে এবং যার মাধ্যমে জনগণ নিজেদেরকে রক্ষা করে।” [মুসলিম]

 

আবু হাজিমের বরাত দিয়ে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন, আমি আবু হুরায়রার সাথে পাঁচ বছর অতিবাহিত করেছি এবং তাকে বলতে শুনেছি, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “বনী ইসরাঈলকে শাসন করতেন নবীগণ। যখন এক নবী মৃত্যুবরণ করতেন তখন তার স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোনও নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলিফা আসবেন। তাঁরা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন তখন আপনি আমাদের কী করতে আদেশ করেন? তিনি (সাঃ) বললেন, তোমরা একজনের পর একজনের বায়াত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে। অবশ্যই আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তায়ালা) তাদেরকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের ব্যাপারে প্রশ্ন করবেন।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যদি কেউ তার আমিরের মধ্যে এমন কিছু দেখে যা তার পছন্দ নয় সে যেন ধৈর্যধারণ করে। সাবধান! এজন্য যদি কেউ নিজেকে সুলতান (ইসলামিক নেতৃত্ব) থেকে এক বিঘাত পরিমানও আলাদা করে নেয় অতঃপর সে অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে তবে তার মৃত্যু হবে জাহেলীয়াতে।” [বুখারী ও মুসলিম]

 

এসব হাদীসে রাসূল (সাঃ) আমাদের জানিয়েছেন যে ইমাম বা খলিফারা (নেতারা) আমাদের রাজনীতি কায়েম রাখবেন এবং সেই সাথে ইমাম বা খলিফাকে বর্ণনা করেছেন মুসলমানদের ঢাল হিসাবে যিনি মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। ইমামকে ঢালের সাথে তুলনা করা একজন ইমামের উপস্থিতির তীব্র প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে তাই মুসলমানদের উপর একজন ইমাম থাকা একটা দৃঢ় আদেশ। এটা এজন্য যে যখন আল্লাহ ও তার রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে এমন কিছু সম্পর্কে বলেন যার সাথে তিরস্কার উল্লেখিত হয় তবে সেটা একটা বিরত থাকার আদেশ হিসাবে গৃহীত হয়। অন্য কথায় সেই বিষয় থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয় । বিপরীত ভাবে কুরআনের কোনও আয়াত বা রাসূলের (সাঃ) কোনও হাদীসে যদি কোনও বিষয়ের  প্রশংসা উল্লেখিত হয় তবে সে কাজটা আসলে করতে বলা হয়। যদি কোনও একটা ওয়াজিব পালন করার জন্য অন্য কোনও কিছু অবশ্য প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তবে সেটাও ওয়াজিব এবং যদি এমন হয় যে কোনও কিছুর অনুপস্থিতিতে শরিয়তের কোনও আদেশ পালন অসম্ভব হয়ে পড়ে তাহলে তা বর্তমান থাকা ওয়াজিব।

 

এসব হাদীসের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে যারা মুসলমানদেরকে দেখাশোনা করবেন তারা হচ্ছেন খলিফা সুতরাং খলিফা নিয়োগ করা একটা ফরজ কাজ। হাদীস থেকে আমরা আরো জানছি যে ইসলামিক নেতৃত্ব (শাসনকর্তৃত্ব) থেকে মুসলমানদের আলাদা হওয়া নিষেধ (হারাম) এবং তাই এর সাথে থাকার প্রয়োজনেই ইসলামিক নেতৃত্ব (শাসনকর্তৃত্ব) স্থাপন করা মুসলমানদের উপর ফরজ। তাছাড়া রাসূল (সাঃ) মুসলমানদেরকে খলিফার আদেশ মানার নির্দেশ দিয়েছেন এবং যে বা যারা খলিফার সাথে ক্ষমতা নিয়ে  বিরোধ করবে তাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন, যা বস্তুতপক্ষে একজন খলিফা নিয়োগ ও তার খিলাফতকে এমনকি যুদ্ধের মাধ্যমে হলেও রক্ষা করারই একটা আদেশ।

 

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আল আস (রাঃ) হতে ইমাম মুসলিম বর্ণনা করেন,রাসূল (সাঃ) বলেন,‘যখন একজন ইমামের হাতে বায়াত গ্রহণ সম্পূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে যথাসাধ্য মান্য করবে, এমতাবস্থায় যদি কেউ তার সাথে বিরোধ করতে আসে (বায়াত দাবী করে) তবে দ্বিতীয় জনকে হত্যা করবে।’ ” [মুসলিম]

 

অতএব, ইমামের আনুগত্যের আদেশ প্রকৃত পক্ষে একজন ইমাম নিয়োগেরই আদেশ এবং যারা তার সাথে বিরোধ করবে তাদের সাথে যুদ্ধ করার নির্দেশ থেকেও এটা প্রমাণিত হয় যে একজন মাত্র খলিফা বর্তমান থাকাটা একান্তই আবশ্যক।

 

 
This website was created for free with Own-Free-Website.com. Would you also like to have your own website?
Sign up for free