তৃতীয় অধ্যায়
খিলাফত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নয়:
জনগণকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদানের দিক থেকে বিবেচনা করলে বলা যায় যে, খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা গণতান্ত্রিক নয়; যেখানে জনগণই তাদের ইচ্ছানুযায়ী কোন বিষয়কে অনুমোদন দেয়, নিষিদ্ধ করে, উৎসাহিত করে কিংবা তিরস্কার করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কোন অবস্থাতেই শারী'আহ্ আইনের কাছে দায়বদ্ধ নয়। বরং, তাদের আইন-কানুনের মূলভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিস্বাধীনতা (freedom)। অবিশ্বাসীরা জানে যে, মুসলিমরা গণতন্ত্রকে এর প্রকৃত চেহারায় গ্রহণ করবে না। এ কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, একথা বলে মুসলিম বিশ্বে গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটাতে চেয়েছে যে, গণতন্ত্র শুধুমাত্র শাসক নির্বাচনের একটি পদ্ধতি। এভাবেই তারা মুসলিম উম্মাহ্কে প্রতারিত করেছে এবং উম্মাহ্কে শাসনব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্রকে মেনে নিতে প্ররোচিত করেছে। যেহেতু মুসলিম দেশসমূহ ইতিমধ্যে প্রকৃত রাজতান্ত্রিক কিংবা প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার মোড়কে বিভিন্ন স্বৈরশাসকদের স্বৈরাচারী শাসনের নীচে নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং সেইসাথে, মুসলিম বিশ্বে জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে প্রচন্ডভাবে অবদমিত রাখা হয়েছে, তাই এ ভূমিগুলোতে নতুন শাসক নির্বাচনের পদ্ধতি হিসাবে গণতন্ত্রের বিস্তার ঘটানো সহজ। এভাবেই তারা গণতন্ত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে আলোচনাকে সযত্নে এড়িয়ে গেছে - যা হচ্ছে স্রষ্টার পরিবর্তে তাঁর সৃষ্ট মানুষকে আইন প্রণয়নের ক্ষমতার বিষয়টি।
দূর্ভাগ্যবশত কিছু ইসলামী চিন্তাবিদ, যাদের মধ্যে কিছু উলামাও আছেন, তারা সৎ কিংবা অসৎ নিয়তে এই প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। যদি তাদের কাছে গণতন্ত্র সম্বন্ধে জানতে চাওয়া হয়, তাহলে তারা বলেন এটা শাসক নির্বাচন করার একটি পদ্ধতি মাত্র। আর, এদের মধ্যে যারা অবিশ্বাসীদের মতোই মুসলিমদের সাথে প্রতারণা করতে চায়, তারা গণতান্ত্রিক মতবাদ প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থটি এড়িয়ে গিয়েই এ বিষয়ে জনগণকে তথ্য প্রদান করে।
তারা এ বিষয়ে আলোচনা সবসময় পরিহার করতে চায় যে, গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে মানুষকে সার্বভৌমত্ব প্রদান করা, মানুষের হাতে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা অর্পণ করা, সংখ্যা গরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী আইন প্রণয়ন করা; এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ীই যে কোন বিষয়ে অনুমোদন, নিষেধাজ্ঞা, উৎসাহ প্রদান কিংবা তিরষ্কার করা। এ সকল গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার পরিবর্তে এ মতবাদের প্রচারকরা শুধুমাত্র নির্বাচনের বিষয়টি জনসম্মুখে তুলে ধরে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছানুযায়ী যা খুশী তাই করার জন্য অবশ্যই স্বাধীন হতে হবে (তা না হলে সে সার্বভৌম হবে কিভাবে?) অতএব, এ ব্যবস্থায় সে চাইলে মদ পান করতে পারে, যিনাহ্ করতে পারে, ধর্মত্যাগ করতে পারে কিংবা পবিত্র বিষয় নিয়ে কটুক্তিও পারে। এ সবকিছুই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে অনুমোদিত।
মূলতঃ এটাই হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রকৃত বাস্তবতা এবং প্রকৃত অর্থ। এ সবকিছু অনুধাবন করার পরেও কিভাবে একজন মুসলিম, যে কিনা ইসলামী আক্বীদাহ্'র উপর বিশ্বাস করে বলতে পারে যে, গণতন্ত্র মুসলিমদের জন্য অনুমোদিত কিংবা গণতন্ত্র ইসলাম থেকেই উত্থিত?
ইসলাম জনগণ কর্তৃক খলীফা নির্বাচনের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি নির্ধারণ করেছে। যদিও ইসলামে সার্বভৌমত্ব সম্পূর্ণভাবে শারী'আহ্'র, কিন্তু উম্মাহ্'র (জনগণ) বাই'আতের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়া যে কারও খলীফা হবার একটি মৌলিক শর্ত। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় সেই সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগ থেকেই খলীফা নির্বাচন হয়েছে, যখন সমগ্র বিশ্ব স্বৈরশাসক ও রাজা-বাদশাহদের ভয়ঙ্কর অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়নের অতল গহ্বরে নিমজ্জিত ছিল। কেউ যদি খোলাফায়ে রাশেদীন অর্থাৎ, আবু বকর (রা), উমর (রা), উসমান (রা.) এবং আলী (রা) এর নির্বাচন প্রক্রিয়াকে গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেন, তবে এটা তার কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হবে যে, এদের প্রত্যেককে খলীফা হিসাবে নির্বাচনের ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহ্'র প্রভাবশালী অংশ এবং উম্মাহ্'র প্রতিনিধিদের কাছ থেকে বাই'আত গ্রহণ করা হয়েছিল। উমর (রা.) এর শাসনামলের শেষের দিকে আব্দুর রহমান বিন আউফ (রা) কে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল মুসলিম উম্মাহ্'র প্রতিনিধিদের (তৎকালীন মদীনার জনগণ) কাছ থেকে খলীফা নির্বাচনের ব্যাপারে মতামত সংগ্রহের জন্য।
মদীনার জনগণ খলীফা পদে কাকে নির্বাচিত করতে চায় এ তথ্য অনুসন্ধানে তিনি মদীনার বহুসংখ্যক মানুষের বাসগৃহে প্রবেশ করে জনগণের মতামত যাচাই করেছিলেন। তিনি মদীনার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সাথে এ বিষয়ে কথা বলেছিলেন যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি এ সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, সামগ্রিকভাবে জনমতের পালা উসমান (রা) এর দিকেই ভারী হয়েছে। এরপর, উসমান (রা) কে বাই'আতের মাধ্যমে খলীফা হিসাবে নির্বাচন করা হয়।
পরিশেষে একথা বলা যায় যে, গণতন্ত্র একটি কুফরী ব্যবস্থা। এটি এ কারণে নয় যে, এটা মানুষকে শাসক নির্বাচনের ক্ষমতা দেয়; কারণ এটি প্রকৃতঅর্থে মূল আলোচ্য বিষয়ও নয়। বরং এটি এ কারণে যে, যে কোন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলভিত্তিই হল মানুষের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা, এ মহাবিশ্বের স্রষ্টা আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার নয়। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলা বলেন:
"বস্তুত সার্বভৌমত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো জন্য নয়।" [সূরা ইউসুফ: ৪০]
"কিন্তু না, তোমার রব এর শপথ, এরা কিছুতেই ঈমানদার হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তাদের পারস্পরিক মতভেদের ব্যাপারসমূহে তোমাকে ফায়সালাকারী হিসেবে মেনে নেবে। অতঃপর তুমি যাই ফায়সালা করবে, সে সম্পর্কে তারা নিজেদের মনে কিছুমাত্র কুন্ঠাবোধ করবে না, বরং এর সম্মুখে নিজেদেরকে পূর্ণরূপে সোপর্দ করে দেবে।" [সূরা আন-নিসা : ৬৫]
এরকম আরও অনেক প্রসিদ্ধ দলিল রয়েছে যা নিশ্চিত করে যে, আইন প্রণয়নের একমাত্র ক্ষমতা হল আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'আলার।
এছাড়া, আরও গভীরভাবে বিশ্লেষন করলে দেখা যায় যে, গণতন্ত্র ব্যক্তিস্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়, যেখানে কোন নারী বা পুরুষ হালাল-হারামের প্রতি লক্ষ্য না করেই যা খুশী তাই করতে পারে। গণতন্ত্র ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে ধর্মত্যাগের অধিকার প্রদান করে এবং ধর্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কোনরূপ বাঁধা আরোপ করে না। এছাড়া, মালিকানা অর্জনের স্বাধীনতা মূলতঃ ধনীকে অসৎ ও প্রতারণাপূর্ণ উপায়ে দূর্বলকে শোষণ করার অনুমোদন দেয়; ফলে, ধনীর সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং দরিদ্র আরও বেশী দরিদ্র হতে থাকে। মত প্রকাশের স্বাধীনতা সত্য বলাকে উৎসাহিত করে না, বরং উম্মাহ্'র পবিত্র আবেগ-অনুভূতিকে নির্মম আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করতেই তা ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এটি এ পর্যায়ে ব্যবহৃত হয়ে থাকে যে, যারা মত প্রকাশের ছদ্মাবরণে ইসলামকে আক্রমণ করে তাদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার মানুষ হিসাবে গণ্য করা হয় এবং এ হীনচেষ্টার জন্য তাদেরকে পুরস্কৃতও করা হয়।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ইসলামী শাসনব্যবস্থা (খিলাফত রাষ্ট্রব্যবস্থা) রাজতান্ত্রিক, সাম্রাজ্যবাদী, ফেডারেল, প্রজাতান্ত্রিক কিংবা গণতান্ত্রিক কোনটিই নয়।
খিলাফত ব্যবস্থা কি মাত্র ত্রিশ বছর টিকে ছিল? পর্ব-১
খিলাফাহ জার্নালের একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে ভাষান্তরিত
একথা সর্বজন স্বীকৃত যাতে কোন সন্দেহ নেই যে, ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে সারা বিশ্বের নেতা রাহমাতুল্লিল আলামিন হযরত মুহাম্মদ (সা) এর হাতে প্রথম ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং তা ১৯২৪ সালের ৩ মার্চ বিশ্বাসঘাতক কামাল আতাতুর্কের হাতে তা ধ্বংস হয়। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা বা খিলাফত ব্যবস্থা যে ধারাবাহিকভাবে টিকেছিল তা ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও শরীয়াহর দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যবেক্ষণ করলে তা আমাদের কাছে বোধগম্য হবে।
আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকিয়ে এ ব্যবস্থার ধারাবাহিক অস্তিত্ব বুঝতে চাই, তাহলে দেখতে হবে প্রথমতঃ এ ব্যবস্থার কাঠামো কি ইতিহাস জুড়ে টিকেছিল কিনা। দ্বিতীয়তঃ এ কাঠামোতে সময়ের আবর্তে কি কোন পরিবর্তন এসেছে কিনা। রাসুল (সা) ও খুলাফায়ে রাশেদিনের সময়ের ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধান স্তম্ভগুলো হলঃ
১। খলীফা বা রাষ্ট্রপ্রধান
২। খলীফার প্রতিনিধিত্বকারী সহকারী (মু’ওয়ায়ীন আত তাফউয়ীদ)
৩। খলীফার নির্বাহী সহকারী (মু’ওয়ায়ীন আত তানফীদ)
৪। গভর্ণরবৃন্দ (উ’লাহ্)
৫। আমীর-উল-জিহাদ
৬। বিচার বিভাগ
৭। প্রশাসনিক বিভাগ
৮। উম্মাহ্ কাউন্সিল (মাজলিস আল-উম্মাহ্)
তাই আমরা যদি ১৯২৪ সাল পর্যন্ত ১৩০০ বছরের ইতিহাসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাই পরামর্শ সভা মাজলিস আল উম্মাহটাই শুধু বিভিন্ন সময়ে উপেক্ষিত বা অবহেলিত ছিল। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর মাজলিস আল উম্মাহর প্রতি কিছু সংখ্যক খলীফার উদাসীনতার অর্থ এই নয় যে, পরামর্শ সভা না থাকলেই ব্যবস্থা হিসেবে খিলাফতের অবসান হয়ে গেল। অন্য সব স্তম্ভ টিকে থাকলে মাজলিসুল উম্মাহ বা শুরা ছাড়াও ইসলামী শাসন ব্যবস্থা চলতে পারে, যদিও শুরা উম্মাহর অধিকার। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক সংকট, গৃহযুদ্ধ ও বিদেশী সেনাবাহিনীর আগ্রাসন ঘটলেও এমন কখনো হয় নি যে, মুসলিমরা খলিফা বিহীন ছিল।
নিজের পুত্রকে খলিফা হিসেবে মনোনয়ন দেয়া বা বংশীয় শাসনের অভিযোগ খানিকটা সত্য এবং এটাও সত্য যে, খলীফা নিয়োগের বায়াতের পদ্ধতিতেও কখনো কখনো অনিয়ম দেখা যায়। কিন্তু এটা খিলাফতের ধারাবাহিকতাকে কখনো প্রভাবিত করতে পারেনি। অনেক সময় এমনও ঘটেছে যে, খলীফা তার ছেলেকে যোগ্য মনে করলে তার মৃত্যুর আগেই জনগণের কাছ থেকে ছেলের জন্য বায়াতের শপথ আদায় করেছিলেন। পরবর্তীতে তা আবার নবায়ন করেছেন। এ বায়াত মূলত প্রভাবশালী লোকজন এবং জনপ্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করত।
খুলাফায়ে রাশেদিনের পর খিলাফত টিকে থাকার কথা ইসলামী পণ্ডিতরাও স্বীকার করেছেন। যদিও এদের মধ্যে দু একজন তিরমিযী শরীফের একটি হাদিসের কারণে প্রথম চার খলীফার পর পরবর্তী খলিফাদের ক্ষেত্রে “খলীফা” শব্দটি ব্যবহার করতে অপছন্দ করতেন। সে হাদিসটি হলঃ রাসুল (সা) বলেছেন, “আমার পর আমার উম্মাহর মধ্যে ৩০ বছর পর্যন্ত খিলাফত থাকবে তারপর শুরু হবে বংশীয় শাসন (মুলকান আদ্দুদান) [একই বর্ণনা-সুনানে আবু দাউদ (২/২৬৪) এবং মুসনাদে আহমদ (১/১৬৯) থেকেও পাওয়া যায়।] ইসলামী বিশারদগণ ব্যাখ্যা করেন যে, যেহেতু এ হাদিসটি এ বিষয়ক অন্যান্য হাদিসের সঙ্গে আপাত দৃষ্টিতে সাংঘর্ষিক মত প্রদান করে তাই এই হাদিসের গূঢ় অর্থ ৩০ বছর পর খিলাফত ব্যবস্থা শেষ হয়ে যাবে তা নিশ্চিতভাবে বোঝাচ্ছে না।
জাবির বিন সামুরাহ (রা) বর্ণনা করেন, “রাসুল (সা) বলেন, দীন ইসলাম ততদিন পর্যন্ত টিকে থাকবে যতদিন না আল্লাহর নির্ধারিত ক্ষণ উপস্থিত হয় অথবা কুরাইশ বংশীয় বারজন খলীফা তোমাদেরকে শাসন না করে”।[সহিহ মুসলিম] এ হাদিস থেকে বোঝা যায় মুসলমানদের চার পাঁচ জন নয় বরং একাধিক সংখ্যক খলীফা শাসন করবেন। এ হাদিস অনুসারে খিলাফত ব্যবস্থা শুধু ত্রিশ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা বাস্তব সম্মত নয়। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় কাজী আইয়াদ বলেন, “এই হাদিসটিতে যেখানে বলা হয়েছে ‘আমার পর খিলাফত ৩০ বছর টিকে থাকবে, এর পর শুরু হবে বংশীয় শাসন’ যা পুর্ববর্তী এই হাদিসটির সাথে সাংঘর্ষিক- ‘যত দিন না কুরাইশ বার জন খলীফা উম্মাহকে শাসন করে, ইসলামী দ্বীন ততদিন টিকে থাকবে’। [সহিহ মুসলিম] এ সাংঘর্ষিক মনে হওয়া বিবৃতির সমাধান হল-৩০ বছর খিলাফত টিকে থাকবে নবুয়্যতের আদলে অর্থাৎ সঠিকভাবে পরিচালিত খিলাফত ব্যবস্থার আদলে। বাস্তবে এই ত্রিশ বছর হযরত আবু বকর (রা) থেকে হাসান বিন আলী (রা) এর শাসনকালকেই বোঝায়। [এভাবেই অ্যান নববী তার সহীহ মুসলিমের ব্যাখ্যার মধ্যে উল্লেখ করেছেন পৃষ্ঠা-৮২১। পাঠক লক্ষ্য করুন এ ত্রিশ বছরে চার জন নয় বরং পাঁচ জন খলীফা উম্মাহকে শাসন করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে রাসুল (সা) বলেন, “বনী ইসরাইলকে শাসন করতেন নবীগণ, যখন এক মৃত্যুবরণ করতেন তখন তার স্থলে অন্য নবী আসতেন, কিন্তু আমার পর আর কোন নবী নেই। শীঘ্রই অনেক সংখ্যক খলীফা আসবেন। তারা (রা) (সাহাবীরা) জিজ্ঞেস করলেন, তখন আপনি আমাদের কি করতে আদেশ দেন? তিনি (সা) বললেন, তোমরা তাদের একজনের পর একজনের বায়’আত পূর্ণ করবে, তাদের হক আদায় করবে”। (বুখারী, মুসলিম)
উল্লিখিত হাদিস থেকে বোঝা যায় রাসুল (সা) এর পর কিয়ামত পর্যন্ত আর কোন নবী না আসায় কার তত্ত্বাবধানে মুসলমানদের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালিত হবে সেটা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন এবং সেটা হচ্ছে খিলাফত ব্যবস্থা ও খলীফার তত্ত্বাবধানে।
১২ জন খলীফার বিষয়টিও কাযী আইয়াদ ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন ‘সম্ভবত হাদিসটিতে যে ১২ জন খলিফার কথা বলা হয়েছে – তারা হল এমন ১২ জন খলিফা যাদের শাসনকালে ইসলামের শৌর্য-বীর্য বৃদ্ধি পেয়েছিল-উম্মাহ ঐ সকল নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ ছিল এবং সর্বোপরি খলীফা হিসেবে উম্মাহর দেখাশুনাও তারা ঠিকভাবে করেছিলেন। [আস সুয়্যুতি তারিখ আল খুলাফা, পৃষ্ঠাঃ ১৪]
ইবনে হাজার বলেন, “এই হাদিসটি সম্পর্কে যে কয়েকজন ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্যে কাযী আইয়াদের যুক্তি সবচেয়ে শক্তিশালী কারণ রাসুল (সা) এর কিছু সংশ্লিষ্ট সহীহ হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়েই তিনি যুক্তি তুলে ধরেছেন। যেমনঃ এ সম্পর্কে রাসুল (সা) বলেন, লোকেরা তাদেরকে কেন্দ্র করে একত্রিত হবে......”। (ফাতহুল বারী) এর পাশাপাশি ইবনে হাজার কয়েকজন খলিফার উদাহরণসহ ঐতিহাসিক সত্যতা তুলে ধরেন।
খিলাফত ব্যবস্থা কি মাত্র ত্রিশ বছর টিকে ছিল? পর্ব-২
পূর্ব প্রকাশের পরঃ
খিলাফাহ জার্নালের একটি প্রবন্ধ অবলম্বনে ভাষান্তরিত
ইমাম শাফি (র) এর অনুসারী ফিকাহ বিশেষজ্ঞ সাইফ আল দিন আল আমিদি তার বইয়ের মধ্যে (আল ইমামা মিন আবকার আল আফকার ফি উসুল আদ দিন, পৃ-৩০৬) সংশ্লিষ্ট হাদিসটির ব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, এ হাদিসটিতে বলা হয়েছে ‘আমার খিলাফত থাকবে ৩০ বছর তারপর এতে বংশীয় শাসনের রীতি আসবে’। এ হাদিসটিতে চার খলীফা [আবু বকর, উমর, উসমান, আলী (রা)] পর্যন্ত খিলাফত ব্যবস্থা টিকে থাকবে তা বোঝায়নি।এবং এই হাদিসটি দিয়ে শুধু এ কথাও বোঝায়নি যে, চার খলীফার সময় পর্যন্ত খিলাফত ব্যবস্থা সীমাবদ্ধ থাকবে। বরং রাসুল (সা) বুঝিয়েছেন-তাঁর পর কোন প্রকার বিচ্যুতি ছাড়া তাঁর নেতৃত্বের ধরণ (সুন্নাহ অনুসারে) ইমাম বা খলীফারা উল্লেখিত সময় পর্যন্ত নেতৃত্ব দেবেন। এর পর বেশীর ভাগ শাসকরাই উত্তরাধিকার সূত্রে রাষ্ট্রপ্রধানের পদ অলংকৃত করে শাসন করবেন। তা সত্ত্বেও যে খিলাফত ব্যবস্থা টিকে ছিল তা নিচের দুটি বিষয় থেকে বোঝা যায়।
প্রথমতঃ পরবর্তী সকল সময়ে উম্মাহর মধ্যে এ ব্যাপারে ঐক্যমত ছিল যে তাদের একজন ইমাম বা খলীফা থাকতে হবে এবং তাকে মানা আবশ্যক।
দ্বিতীয়তঃ তিনি (সা) বলেছেন, ‘তারপর আসবে (তাসির) মুলকান’। এখানে যে সর্বনামটি ব্যবহার করা হয়েছে সে ‘তসিরু মিলকান’ দিয়ে খিলাফতকেই নির্দেশ করা হচ্ছে। উল্লিখিত ক্রিয়াটি (তাসিরু) খিলাফতকে ছাড়া অন্য কোন কিছুকেই বোঝায় না। এ দিয়ে আরও প্রতিপন্ন হয় যে খিলাফতই ‘মুলকে’ পরিণত হবে। কেননা একটি বিষয় অন্য বিষয়ে পরিণত হতে গেলে প্রথম বিষয়টির অস্তিত্বে থাকা অবশ্যই জরুরী। এখানে প্রথম উল্লিখিত বিষয়ে ইমাম আমিদি ব্যাখ্যা করেন, দলিল অনুসারে উম্মাহকে অবশ্যই সে যুগের ইমামকে (খলীফাকে) মানতে হবে। এটা দিয়ে অবশ্যই এক খলীফার পর আরেক খলীফা আসার বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ করা হয় নি। আমিদির দ্বিতীয় যুক্তি হল ভাষাতাত্ত্বিক। উক্ত হাদিসটির বক্তব্য হল- খিলাফতের চরিত্র বা প্রেক্ষিত পরিবর্তিত হয়েছে; খিলাফত ব্যবস্থা নিজে নয়। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে যেমনঃ ‘তারপর তারেক রেগে গেল’ এখানে তারেকের অবস্থান বা গুণগত অবস্থার পরিবর্তন বুঝিয়েছে। অর্থাৎ তারেক রেগে গিয়ে আলী বা উমরে পরিণত হতে পারে না। একইভাবে হাদিসটিতে যখন বলা হয়েছে “সুম্মা তাসিরু মুলকান” এর অর্থ হল এবং ‘এরপর আসবে বংশীয় শাসন’ এ বাক্যাংশ দিয়ে কখনো বোঝা যায় না যে খিলাফত ব্যবস্থা শেষ হয়ে গেল। বরং ঐ ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন আসাকে বোঝায়।
৯০৩ হিজরিতে খলীফা মুতাওয়াক্কিল আবুল আইজ মৃত্যুবরণ করেন। তার স্থানে তার ছেলে আল মুসতামসিক বিল্লাহ খলীফা নিযুক্ত হন। এ সময়ে বিখ্যাত ইসলামী পণ্ডিত ইমাম জালাল আল-দিন সুয়ুতি তার আল খোলাফা (খলীফাদের ইতিহাস) বইয়ে তখন পর্যন্ত খলীফা হসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছেন তাদের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তিনি এ বইয়ের সূচনায় বলেন, “আবু বকর (রা) এর মৃত্যুর পর থেকে এ পর্যন্ত যত খলীফা শাসন করেছেন এখানে সংক্ষেপে সে সব খলীফাদের জীবনী তুলে ধরলাম। যারা ছিলেন বিশ্বাসীদের নেতা (আমীর উল মুমিনিন) যারা উম্মাহর সকল বিষয় নিয়ে দেখাশুনা করতেন”। তার এই বই লেখার সময়টা ছিল হিজরতের ৯০০ বছর পর। সমস্ত খিলাফতের সময়কাল জুড়েই তৎকালীন খলীফাদের সাথে ইসলামী পণ্ডিতদের যোগাযোগ ছিল। কেউ কেউ খলীফাদের বিভিন্ন কাজের কৈফিয়ত বা ইসলামী ব্যাখ্যা চাইতেন। আবার কেউ কেউ তাদের শাসন কাজে সরাসরি সহযোগিতা করতেন। উদাহরণ দিয়ে বলা যায়-ইমাম আবু হানিফা খলীফা আল মানসুরের এক সিদ্ধান্তের কৈফিয়ত চেয়েছিলেন। কাজি আবু ইউসুফ খলীফা হারুন অর রশিদের শাসন আমলে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুসতানসির বিল্লাহ তাতারদের পরাজিত করার পর আইজ বিন আব্দুস সালাম তার নিকট বায়’আত গ্রহণ করেছিলেন।
উসমানীয় খিলাফতের শেষের দিকে পশ্চিমা পুঁজিবাদী শক্তিগুলো যখন মুসলিমদের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে দিল দেয়ার ষড়যন্ত্রে মগ্ন ছিল তখন মাওলানা কাশিম নুতভি (র) এর সরাসরি ছাত্র ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মাওলানা মুহাম্মদ হাসান (র) ১৯২০ সালে ইসলামের শত্রুদের সাম্রাজ্যবাদী ছোবল থেকে উসমানীয় খিলাফতকে রক্ষা করার জন্য মুসলিমদের উদ্দেশ্যে এক ফতোয়া জারি করেন। সম্মানিত মাওলানা হাসান বলেন ‘ইসলামের শত্রুরা ইসলামের সম্মান ও প্রতিপত্তি ধ্বংস করতে চেষ্টার ত্রুটি করছে। ইরাক, ফিলিস্তিন, সিরিয়ার উপর তাদের লোভাতুর দৃষ্টি পড়ছে। মুসলমানদের খলীফা – যিনি সারা বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করেন, পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি, ইসলামের সার্বজনীন আইন বাস্তবায়নকারী; যিনি মুসলিমদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষা করেন এবং সৃষ্টিকর্তার সম্মানিত বাণী পৃথিবীর বুকে রক্ষা ও বাস্তবায়নকারী, সেই খলীফারা আজ শত্রু বেষ্টিত ……… [মাওলানা সাইদ মুহাম্মদ মিয়ার “দ্যা প্রিজনার অফ মাল্টা” বইয়ে ২৯ অক্টোবর ১৯২০ সালে জারিকৃত ফতোয়াটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশ করেন, পৃষ্ঠা ৭৮]
খিলাফত আন্দোলনের বিশিষ্ট নেতা মাওলানা মুহাম্মদ আলি যোহার খিলাফত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “তুরস্কের খলীফারা হল রাসুল (সা) এর উত্তরাধিকারী। মুমিনদের নেতা বা বিশ্বাসীদের প্রধান। যার অস্তিত্বের কথা কুরআন ও রাসুলের সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। (মোহাম্মদ আলী যোহার, মাই লাইফ এ ফ্রাগমেন্ট)। এ প্রসঙ্গে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলান আবুল কালাম আজাদের ১৯২০ সালে খিলাফত নিয়ে লেখা “দ্যা ইস্যু অব খিলাফত” বইয়ের শুরুতেই লিখেন, খিলাফত ছাড়া ইসলামের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। ইন্ডিয়ার মুসলমানদের উচিত তাদের সর্বোশক্তি ও সামর্থ্য দিয়ে খিলাফত রক্ষা করার জন্য কাজ করা”। বইটির মধ্যে আবু বকর (রা) থেকে শুরু করে ১৯২০ সাল পর্যন্ত সকল খলীফার একটি তালিকাও তিনি সংযোজন করেন। খিলাফতের শেষ পর্যায়ে এসেও তাই আমরা দেখতে পাই খিলাফত টিকিয়ে রাখার ব্যাপারে উলামারা যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলেন। খুলাফায়ে রাশেদিনের পর খিলাফতের ধারাবাহিকতা থাকাটা আহলে আল সুন্নাতের বিশ্বাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এ প্রসঙ্গে শাফি মাযহাবের ইমাম আত-তাফ তাজানী হানাফী মাযহাবের ইমাম অ্যান নাসাফির চিন্তার সঙ্গে সম্পুর্ণ একমত পোষণ করেন। এ বিষয়ে আত-তাফ তাজানী বলেন, উম্মাহর জন্য একজন ইমাম নিয়োগ করা যে বাধ্যতামূলক সে বিষয়ে সকল ইমামের মধ্যে মতৈক্য আছে। কারণ রাসুল (সা) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি এমন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে যে তার কাঁধে কোন খলীফার বায়’আত (আনুগত্যের শপথ) নেই তবে তার মৃত্যু হচ্ছে জাহেলিয়াতের মৃত্যু” (মুসলিম)। আত তাফ তাজানী আরও বলেন, “মুসলিমদের একজন ইমাম থাকা বাধ্যতামূলক যিনি মুসলমানদের প্রশাসন পরিচালনা করবেন। যিনি মুসলিমদের জন্য নির্দেশিত ডিক্রিগুলো রক্ষা করবেন, মুসলিমদের ভৌগলিক সীমানা সুরক্ষিত রাখার ব্যবস্থা করবেন, মুসলিম সেনাবাহিনীকে যথাযথ সামরিক সরঞ্জামে সুসজ্জিত রাখবেন, জনগণের দানের অর্থ গচ্ছিত রাখবেন, জুম্মাহর নামাজ ও প্রধান প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দিবেন, সৃষ্টিজগতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করবেন, বৈধ অধিকার রক্ষার পক্ষে তিনি এভিডেঞ্চ গ্রহণ করবেন। অভিভাবকহীন যুবক যুবতীদের নিজ অভিভাবকত্বে বিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।[আকিদাত অ্যান নাসাফিয়া পৃঃ ১৪৭]
ঐতিহাসিক বাস্তবতা ও দলীলের নিরীখে ইমাম তাফ-তাজানী বক্তব্য যে ঠিক তা বোঝা যায়। একজন খলীফা নিয়োগ করা মুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক যা রাসুল (সা) এর সুন্নাহেরই প্রতিফলন। তাই উল্লেখিত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলা যায় আমাদের সমাজে খিলাফতের কাল “ত্রিশ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ” ছিল তা নিতান্তই অবাস্তবিক, অযৌক্তিক ও অলীক অনুমান ছাড়া আর কিছুই নয়। খিলাফত ব্যবস্থা উম্মাহকে দেখাশুনার ব্যবস্থা হিসেবে রাসুল (সা) এর ওফাতের পর উসমানীয় খিলাফতের আমল পর্যন্ত টিকেছিল।
খিলাফত রাষ্ট্র কিভাবে জনগণ কর্তৃক শাসকের জবাবদিহিতা সুনিশ্চিত করবে ?
বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা যাকে বলা হয়ে থাকে জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী ও জবাবদিহিতামুলক সরকার কিন্তু রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে এই ব্যবস্থায় জনগণের ক্ষমতা থাকে সংসদে ৩০০ জন স্বেচ্ছাচারী নির্বাচন করা পর্যন্ত। যার ফলে নির্বাচিত হওয়ার পর তারা জনগণকে ভুলে নিজেদের আখের গুছাতে ব্যস্ত থাকে।
অন্যদিকে শাসকগোষ্ঠীর এই বিশ্বাসঘাতক দেখে জনগণের আর কিছু করার থাকে না কারন তথাকথিত স্বাধীন বিচার বিভাগ সবসময় সরকার পক্ষের উকিলদের দখলে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ন্যায়বিচারতো দূরে থাক বরং জনগণের উপর জুলুম করা হয়।
অনেকে বলে থাকেন খিলাফত রাষ্ট্রে খলিফার স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ আছে। আশা করি এই আলোচনায় আমরা তাদের এই ধারনা পরিবর্তন করতে পারব।
যাইহোক আলোচনাটি দুটি ধাপে করা যেতে পারে:
১। স্বেচ্ছাচারিতা
২। জবাবদিহিতা
স্বেচ্ছাচারীতাঃ
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় মানুষ আইন প্রণয়ন করে। কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে অধিকাংশের মতামত সবসময় সঠিক না হতে পারে আবার মানুষের প্রকৃতিগত কারনে এই সকল আইন স্বার্থান্বেষী ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে বাধ্য। সর্বোপরি, আইন প্রণয়নের মালিক একমাত্র আল্লাহ এবং মানুষ কর্তৃক আইন প্রণয়ন করা প্রকাশ্য কুফর।
অন্যদিকে, খলিফা শরীয়া ব্যতীত অন্য কোন কিছু প্রবর্তন করতে পারবেন না ফলে স্বেচ্ছাচারী হওয়ার কোন সুযোগ নেই।এছাড়াও খলিফা যদি শরীয়ার সাথে সাংঘর্ষিক কিছু করেন তবে মাহাকামাতুল মাযালিমে তার বিচার করা হবে।
জবাবদিহিতা:
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণ ও শাসকের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন বিচার বিভাগ নেই। আর বাস্তবতা হচ্ছে বিচার বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কারনে যে সরকার ক্ষমতায় আসে বিচার তার পক্ষে থাকে। অন্যদিকে সরকারের অপরাধ গুলো দমনের জন্য তথাকথিত দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে যা ক্ষমতাশীলদের হাতিয়ার হিসাবে কাজ করে।
কিন্তু খিলাফত ব্যবস্থায় মাহাকামাতুল মাযালিম একটি বিশেষ আদালত যা কাজ হবে শুধুমাত্র জনগণ ও শাসকের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসা করা। যদিও এই বিভাগের বিচারপতিকে খলিফা নিয়োগ করবেন কিন্তু খলিফাকে নিয়ে কোন বিচার চলাকালীন সময়ে খলিফা বিচারপতিকে বরখাস্ত করতে পারবেন না। মাহাকামাতুল মাযালিমের বিচারক নিজে থেকেও সরকারে দুর্নীতির বিষয়ে খেয়াল রাখবেন এবং এর জন্য কারো মামলা করার প্রয়োজন নেয়।
নিম্নে মাহাকামাতুল মাযালিম সম্পর্কে আরও বিস্তারিত আলোচনা করা হল:
ইসলামী শারী’আহ্ বিচারকদের তিন ভাগে ভাগ করে:
একজন হলেন কাজী-উল-খুশুমাত - যিনি হুদুদ এবং লেনদেনের ক্ষেত্রে জনগণের মধ্যকার বিবাদ নিরসন করবেন।
দ্বিতীয় জন হলেন কাজী-উল-মুহতাসিব - যিনি কোন আইন ভঙ্গের কারণে জনগণের স্বার্থ এবং তাদের সম্পদের জন্য ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করবেন।
এবং তৃতীয় জন হলেন, কাজী-উল-মাজালিম - যিনি রাষ্ট্র এবং জনগণের মধ্যকার বিরোধ নিরসনের দায়িত্বে ন্যাস্ত থাকেন।
বিচারকের যোগ্যতার শর্তাবলী
যিনি বিচারকের গুরুদায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তাকে অবশ্যই মুসলিম, মুক্ত (আজাদ), পূর্ণবয়স্ক, সুস্তমস্তিষ্কসম্পন্ন, ন্যায় বিচারক, ফকীহ (বিজ্ঞ আলেম) এবং শরীয়াহর আইন প্রয়োগের ক্ষমতাসম্পন্ন হতে হবে।
যিনি মাজালিমের বিচারকের দায়িত্বভার গ্রহণ করবেন তাকে উপরোক্ত শর্তপূরণ করা ছাড়াও পুরুষ ও মুজতাহিদ হতে হবে, যা প্রধান বিচারপতির (chief justice) ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ মাজালিমের বিচারকের কাজে বিচার ও শাসন দু’টি বিষয় জড়িত ও এখানে শাসকের উপর শরীয়াহ বাস্তবায়ন করা হয় । সুতরাং বিচারকের অন্যান্য পদের ব্যতিক্রম হিসেবে অতিরিক্ত যোগ্যতার শর্তে মাজালিমের বিচারককে পুরুষ হতে হবে। আবার শাসকগণ আল্লাহর আইন ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে শাসন করছেন কিনা অর্থাৎ এমন কোন আইন প্রয়োগ করছেন যার কোন শরীয়াগত ভিত্তি নেই বা যে ভিত্তি তিনি ব্যবহার করছেন তা ঘটনার সাথে সামজ্ঞস্যপূর্ণ নয়, তা বুঝবার জন্য তাকে মুজতাহিদও হতে হবে, । একজন মুজতাহিদই এ ধরনের মাজালিমা বুঝতে পারবেন। আর তাই যদি তিনি মুজতাহিদ না হন, তাহলে এমন কোন কিছু দিয়ে বিচারকার্য পরিচালনা করবেন যে ব্যাপারে তার জ্ঞান নেই - যা হারাম। সেকারণে শাসক পদ ও অন্যান্য বিচারিক পদের ব্যতিক্রম হিসেবে অতিরিক্ত যোগ্যতার শর্তে মাজালিমের বিচারককে মুজতাহিদ হতে হবে।
মাজালিম এর বিচারক
মাজালিমের বিচারককে নিয়োগ দেয়া হয় রাষ্ট্র কর্তৃক ব্যক্তির উপর যে কোন মাজালিমা বা অন্যায় আচরণের বিচারের জন্য। আর এ ব্যক্তি রাষ্ট্রের নাগরিক বা অধীনস্ত কেউ হতে পারেন। আর এ মাজালিমা বা অন্যায় আচরণ খলিফা, খলিফার অধীনস্ত কেউ কিংবা কোন সরকারী জনপ্রশাসন সংঘটিত করতে পারেন
মাজালিমের বিচারক নিয়োগ ও অপসারণ
খলিফা বা প্রধান বিচারপতি মাজালিমের বিচারক নিয়োগ করে থাকেন। যেহেতু মাজালিম বিচারব্যবস্থার একটি অংশ সেহেতু সব ধরনের বিচারকদের অবশ্যই খলিফাই নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এটি জানা যায় রাসূলুল্লাহ (সা:) এর কাজ থেকে যে, তিনি নিজে সব বিচারকদের নিয়োগ দিতেন। এ থেকে বুঝা যায় যে, মাজালিমের বিচারককে খলিফাই নিয়োগ দেবেন। তবে প্রধান বিচারপতি এ নিয়োগ দিতে পারবেন যদি এ সংশ্লিষ্ট একটি অনুচ্ছেদ তার নিয়োগে উল্লেখিত থাকে। এটা অনুমোদিত যে, রাষ্ট্রের রাজধানীতে অবস্থিত মাজালিমের প্রধান আদালত (মাহকামাত উল মাজালিম) খলিফা, তার সহকারীগন ও প্রধান বিচারপতির মাজালিমা খতিয়ে দেখবেন। বিভিন্ন প্রদেশে অবস্থিত মাজালিমের আদালতের শাখাসমূহ ওয়ালী ও অন্যান্য সরকারী কর্মকর্তাদের মাজালিমা খতিয়ে দেখবেন। খলিফা কেন্দ্রীয় মাজালিম আদালতের বিচারপতিকে বিভিন্ন প্রদেশের শাখা আদালতসমূহের মাজালিম বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষমতা দিতে পারেন।
মাজালিমের প্রধান আদালত (মাহকামাত উল মাজালিম) এর বিচারপতিদের খলিফা নিয়োগ ও অপসারণ করতে পারবেন। কেন্দ্রীয় মাহকামাত উল মাজালিম-এর প্রধান বিচারক এর ক্ষেত্রে, যিনি খলিফার অপসারণের বিষয়টি খতিয়ে দেখেন; অপসারণের ব্যাপারে নীতিগতভাবে খলিফাই দায়িত্বশীল যেহেতু তিনি তাকে নিয়োগ দিয়ে থাকেন। কিন্তু খলিফার উপর কোন তদন্ত বা বিচার চলাকালে মাহকামাত উল মাজালিমকে অপসারণের ক্ষমতা খলিফার হাতে থাকলে তা হারামের দিকে যাবে। এ অবস্থায় এই মূলনীতিটি প্রযোজ্য যে, ‘হারাম করবার উপায়সমূহও হারাম’। এ ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকায় উক্ত নীতিটি ভালভাবেই প্রযোজ্য।
এ ধরনের পরিস্থিতি তখনই উদ্ভব হবে যখন খলিফা, তার সহযোগীবৃন্দ বা প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কোন মামলা চলতে থাকবে। উক্ত পরিস্থিতিতে ঐ সময় মাহকামাত উল মাজালিম কে অপসারণের ক্ষমতা খলিফার হাতে থাকলে তা বিচারের রায়কে প্রভাবিত করতে পারে এবং এভাবে খলিফা এবং তার সহযোগিকে অপসারণের ক্ষমতা সংকুচিত হতে পারে।
মাজালিমের বিচারকের আবশ্যিক ক্ষমতা
মাজালিমের বিচারকের দায়িত্ব হল যে কোন ধরনের মাজলিমা বা অন্যায় আচরণ খতিয়ে দেখা। হোক সেটা সরকারী কর্মচারীর মাধ্যমে, অথবা খলিফার কাজের সাথে শরীয়ার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত, বা খলিফা কর্তৃক জারিকৃত আইন-কানুন সংক্রান্ত বা সংবিধানের আইনি ব্যাখ্যা সংক্রান্ত, কিংবা নতুন করারোপ ইত্যাদি কারণে সৃষ্ট।
মাজালিমের বিচারকের কাছে অভিযোগ করা না হলেও সংশ্লিষ্ট আইন ভঙ্গের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবার ব্যাপারে দলিল রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে এখানে কোন ফরিয়াদি থাকা অপরিহার্য নয়। মাজালিমের বিচারকের কাছে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের না করলেও যে কোন মাজালিমা তদন্ত করার এখতিয়ার তার রয়েছে এবং এর জন্য ফরিয়াদি বা অভিযুক্ত কারোরই অংশগ্রহণ জরুরী নয় ।
চলবে-------