2-"তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধঃ মাহদি ও দাজ্জাল"
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১১] দাজ্জালের অবস্থানে সময় থেমে যাবে কি?
সময়ের থেমে যাওয়া দাজ্জালের জাদুর ক্রিয়া হবে কিংবা সে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে এমনটি করবে। কেননা, সাহাবা কিরাম যখন জিজ্ঞেস করলেন, “হে আল্লাহর রাসুল, এই অবস্থায় আমরা নামাজ কত ওয়াক্ত পড়ব? তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিয়েছিলেন, সময় অনুমান করে নামাজ আদায় করতে থাকবে। দাজ্জালি শক্তিগুলো সময়ের গতিকে রোধ করার লক্ষ্যে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আপনি হয়তো শুনে থাকবেন, ‘টাইম মেশিন’ নামে এমন একটি প্রযুক্তি আবিস্কারের চেষ্টা চলছে, যার সাহায্যে মানুষকে বিগত সময়ে পৌঁছে দেওয়া যায়। মানুষ মূলত বর্তমান সময়েই অবস্থান করবে; কিন্তু মেশিনটির সাহায্যে মনে হবে, এখনও বিগত সময়ের মধ্যেই রয়েছে। এর স্পষ্ট চিত্র হয়তো শীঘ্রই বিশ্ববাসীর সামনে চলে আসবে। সাহাবাগনের দাজ্জালের গতি ও দুনিয়াতে তার অবস্থানের মেয়াদকাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা তাদের সামরিক চিন্তার প্রমাণ বহন করে। প্রশ্নটি করে তারা জানতে চেয়েছিলেন, আমাদেরকে দাজ্জালের সাথে কতদিন যুদ্ধ করতে হবে। যেহেতু যুদ্ধে চলাচল এবং দৌড়ঝাঁপ একটি অতিশয় গুরুত্তপূর্ন বিষয়, তাই তারা জিজ্ঞেস করেছিলেন, দাজ্জালের গতি কেমন হবে? দাজ্জালের মেয়াদকালের প্রথম দিনটি এক বছরের সমান হবে। দ্বিতীয় দিনটি এক মাসের সমান হবে আর তৃতীয় দিনটি দিনটি হবে এক সপ্তাহের সমান। অবশিষ্ট ৩৭ দিন সাধারণ দিবসের মতো হবে। এই হিসাবে দাজ্জালের দুনিয়াতের অবস্থানের মেয়াদকাল এক বছর দুই মাস চৌদ্দ দিনের সমান হয়।
একদিন এক বছরের সমান হবে। কোন কোন বিশ্লেষক দিবসের দীর্ঘ হওয়ার অর্থ এই লিখেছেন যে, পেরেশানির কারণে দিনটি দীর্ঘ বলে মনে হবে।কিন্তু মুসলিম শরীফের ব্যাখ্যাকার ইমাম নববি (রহঃ) লিখেছেন, হাদিস বিশেষজ্ঞদের মতে হাদিস দ্বারা বাহ্যত যা বোঝা যাচ্ছে, বাস্তবে তা-ই এর মর্ম। অর্থাৎ প্রথম তিনটি দিন এতটাই দীর্ঘ হবে, যা হাদিসে বলা হয়েছে। অবশিষ্ট দিনগুলো সাধারণ দিনেরই মতো হবে। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এই উক্তিই তার প্রমাণ বহন করে। তা ছাড়া সাহাবা কিরাম এই যে প্রশ্ন করেছেন, “ উক্ত দিনগুলোতে আমরা নামাজ কত ওয়াক্ত পড়ব আর তখন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উত্তর দিয়েছিলেন, সময় হিসাব করে নামাজ আদায় করবে” – এ বিষয়টিও প্রমাণ করে যে, এখানে প্রকৃত দীর্ঘতা-ই বোঝানো হয়েছে। ‘দাজ্জাল তার ডানে ও বাঁয়ে অনাচার ও বিপর্যয় ছড়াতে থাকবে’ – একথার অর্থ হল, সে যেখানেই যাবে, সেখানেই অনাচার ও বিপর্যয় তৈরি হবে। তার ডানে বাঁয়ে তার এজেন্টরা বিপর্যয় তৈরি করতে থাকবে। যেমনটি আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি যে, প্রধান সেনাপতি বিশেষ বিশেষ জায়গায় যান। অবশিষ্ট জায়গাগুলোতে তার অধীনদের পাঠিয়ে দেন। এই দাবীর পক্ষে সেই বর্ণনাগুলো প্রমাণ বহন করছে, যেগুলোতে বলা হয়েছে, দাজ্জাল যখন এক যুবক সম্পর্কে সংবাদ পাবে, সে তাকে মন্দ বলছে, তখন সে তার লোকদেরকে বার্তা পাঠাবে, অমুক যুবককে ধরে আমার কাছে নিয়ে আসো। নুআঈম ইবনে হাম্মাদ ‘আলফিতানে’ এই বর্ণনাটি উল্লেখ করেছেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে, দাজ্জাল ছাড়াও তার লোকেরা মুমিনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকবে আর দাজ্জাল স্থানে স্থানে গিয়ে তাদের দেখভাল করবে।
----
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১২] দাজ্জাল হিসাবে ইবনে সায়্যাদকে সন্দেহ
দাজ্জাল সম্পর্কে ইবনে সায়্যাদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করাটা সঙ্গত বলে মনে করি। ইবনে সায়্যাদ ইহুদি ছিল। লোকটি মদিনায় বাস করত। তার আসল নাম ছিল ‘সাফ’। সেই ইহুদি জাদু ও ভেলকিবাজিতে খুব পারদর্শী ছিল। দাজ্জালের মধ্যে যে সব লক্ষন থাকার কথা রয়েছে, তার মধ্যে তার অনেকাংশই পাওয়া যেত। এ কারণে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও ইবনে সায়্যাদের ব্যাপারে চিন্তিত থাকতেন এবং তার পরিচয় জানতে একাধিকবার তার কথাবার্তা শুনবার চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত তার সম্পর্কে কোন সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেননি যে, ইবনে সায়্যাদই দাজ্জাল কিনা। অনুরূপভাবে শীর্ষস্থানীয় অনেক সাহাবীও ইবনে সায়্যাদকেই দাজ্জাল মনে করতেন। এখানে এ সংক্রান্ত কয়েকটি হাদিস উদ্ধৃত করছি।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদিন হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) একদল সাহাবার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ইবনে সায়্যাদ এর নিকট গেলেন। তিনি তাকে বনু মাগালায় (ইহুদি একটি পল্লীতে) ক্রীড়ারত অবস্থায় পেলেন। বয়সে তরুণ। ইবনে সায়্যাদ তাদের গমনের সংবাদ টের পেল না। এমনকি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পিঠে হাত রাখলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল?
প্রশ্নটি শুনে ইবনে সায়্যাদ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পানে তাকাল এবং বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, তুমি অজ্ঞ লোকদের রাসূল। তারপর সে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে, আমি আল্লাহর রাসূল? উত্তরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে ধরে সজোরে চাপ দিলেন এবং বললেন, আমি আল্লাহর উপর ও তার রাসুলগনের উপর ঈমান এনেছি। তারপর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জিজ্ঞেস করলেন, বলো তো তুমি কি দেখছো? অর্থাৎ অদৃশ্য বস্তুসমূহের মধ্যে তুমি কি কি দেখতে পাও? সে বলল, কখনও তো আমার কাছে সঠিক সংবাদ আসে, আবার কখনও মিথ্যা আসে। একথা শুনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তোমার পুরো বিষয়টিই এলোমেলো হয়ে গেছে। তারপর বললেন, আমি তোমার জন্য হৃদয়ে একটি কথা লিখিয়ে রেখেছি। সে বলল, সেই গোপন বিষয়টি হল ধোঁয়া। একথা শুনে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দূর হও, তুমি তোমার সময় হতে একটুও অগ্রসর হতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে হযরত ওমর (রাঃ) বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল, অনুমতি দিন, আমি ওর ঘাড়টা উড়িয়ে দেই। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ইবনে সায়্যাদ যদি সেই দাজ্জাল হয়, তা হলে তুমি তাকে হত্যা করতে পারবে না, আর যদি সে না হয়, তাহলে একে হত্যা করে কোন লাভ নেই।
ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, একদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খেজুরের সেই গাছগুলোর কাছে গমন করলেন, যেখানে ইবনে সায়্যাদ অবস্থান করছিল। তখন উবাই ইবনে কাব আনসারী (রাঃ) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গী ছিলেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওখানে পৌঁছে কতগুলো খেজুর ডালের পিছনে লুকোতে শুরু করলেন, যাতে ইবনে সায়্যাদ টের পাওয়ার আগেই তিনি তার কিছু কথা শুনে নিতে পারেন। ইবনে সায়্যাদ তার গাঁয়ে চাদর মুড়িয়ে শুয়ে ছিল এবং ভিতর থেকে গুনগুনানির শব্দ আসছিল। এই সময় ইবনে সায়্যাদের মা খেজুর ডালের আড়ালে লুকিয়ে থাকা নবীজিকে দেখে ফেলল এবং বলে উঠল, হে ছাফ, এই যে মোহাম্মদ এসেছে। শুনে ইবনে সায়্যাদ গুনগুনানি বন্ধ করে দিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ওর মা যদি ওকে সতর্ক না করত, তা হলে আজ সে তার আসল রূপ প্রকাশ করে দিত।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, এই ঘটনার পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন খুতবা দিতে জনতার সামনে দাড়ালেন, তখন তিনি মহান আল্লাহর যথাযথ প্রশংসা জ্ঞাপন করলেন। তারপর দাজ্জালের আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করছি। নূহ এর পরে এমন কোন নবী অতিবাহিত হননি, যারা দাজ্জাল সম্পর্কে আপন জাতিকে সতর্ক করেননি। নূহও তার জাতিকে দাজ্জাল সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তবে আমি তোমাদেরকে দাজ্জাল সম্পর্কে এমন একটি কথা বলতে চাই, যা ইতিপূর্বে কোন নবী বলেননি। তোমরা জেনে রাখো, দাজ্জাল হবে কানা আর নিশ্চিত জানো, আল্লাহ কানা নন’।
(সহিহ বুখারি, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ১১১২; সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৪৪)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, একদিন রাস্তায় ইবনে সায়্যাদের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। সে সময় তার চোখ ফোলা ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার চোখে এই ফোলা কবে থেকে? সে বলল, আমার জানা নেই। আমি বললাম, চোখ হল তোমার মাথায় আর তুমি জান না? সে বলল, আল্লাহ চাইলে এই চোখটি তোমার লাঠিতে সৃষ্টি করে দিতে পারেন। ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, এই কথোপকথনের পর ইবনে সায়্যাদ তার নাক থেকে সজোরে এমন একটি শব্দ বের করল, যা গাধার শব্দের মতো ছিল’।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৩৯৮)
হযরত মুহাম্মদ ইবনে মুনকাদির তাবেয়ী (রহঃ) বলেন, আমি হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) কে দেখেছি যে, তিনি কসম খেয়ে বলতেন, ইবনে সায়্যাদ দাজ্জাল। আর নবীজি তা অস্বীকার করেননি।
(সহিহ বুখারি, হাদিস নং ৬৯২২; সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৯২৯)
হযরত নাফে’ (রহঃ) বলেন, ইবনে ওমর (রাঃ) বললেন, আল্লাহর শপথ, আমার এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইবনে সায়্যাদই দাজ্জাল। ইমাম আবু দাউদ ও বায়হাকী এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম আবু দাউদ ও বায়হাকী মাজাহিবে হক জাদীদ-এর সূত্রে ‘কিতাবুল বাছি ওয়ান নুশূর’ এই বর্ণনাটি উদ্ধৃত করেছেন।
হযরত আবু বাকরাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন, একদিন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, দাজ্জালের পিতামাতা ত্রিশ বছর যাবত এমন অবস্থায় অতিবাহিত করবে যে, তাদের কোন সন্তান জন্মাবে না। ত্রিশ বছর পর তাদের ঘরে একটি পুত্র সন্তান জন্ম নেবে, যার বড় বড় দাঁত থাকবে। সে অল্প উপকারী হবে। তার চোখ দুটো ঘুমবে বটে; কিন্তু অন্তর ঘুমবে না। এটুকু বলার পর নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের সামনে তার পিতামাতার অবস্থা বর্ণনা করলেন এবং বললেন, তার পিতা অস্বাভাবিক দীর্ঘাকায় হবে এবং শরীরে গোশত কম হবে। তার নাক মোরগের চক্ষুর মতো (লম্বা ও সরু) হবে। তার মা হবে মোটা, চওড়া ও দীর্ঘ হাতের অধিকারী।
আবু বাকারাহ (রাঃ) বলেন, আমরা মদিনার ইহুদীদের মাঝে একটি (বিরল ও বিস্ময়কর) ছেলের উপস্থিতির কথা শুনলাম। তখন আমি ও জুবাইর ইবনে আওয়াম তাকে দেখতে গেলাম। আমরা ছেলেটির পিতামাতার কাছে পৌঁছে দেখলাম, তারা হুবহু তেমন, যেমনটি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেছেন। আমরা তাদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের কোন পুত্র সন্তান আছে কি? তারা বলল, আমরা ত্রিশটি বছর এভাবে অতিবাহিত করলাম যে, আমাদের কোন পুত্রসন্তান জন্মায়নি? পরে আমাদের ঘরে একটি কানা পুত্র সন্তান জন্মাল, যার দাঁতগুলো বড় বড় এবং কম হিতকর। তার চোখ দুটো ঘুমায় বটে, কিন্তু অন্তর ঘুমায় না। আবু বাকারাহ (রাঃ) বলেন, আমরা ওখান থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। এবার হঠাৎ উক্ত ছেলেটির উপর আমাদের দৃষ্টি পতিত হল। ছেলেটি রোদের মধ্যে গাঁয়ে চাদর জড়িয়ে পড়ে ছিল এবং চাদরের মধ্য থেকে এমন এক গুনগুনানির শব্দ আসছিল, যার কোন মর্ম বোঝা যাচ্ছিল না। আমরা ওখানে দাঁড়িয়ে পরস্পর কথা বলতে শুরু করলাম। হঠাৎ ছেলেটি মাথা থেকে চাদর সরিয়ে আমাদেরকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কি বলছ? আমরা বিস্মিত হয়ে বললাম, তুমি কি আমাদের কথা শুনে ফেলেছ? সে বলল, হ্যাঁ, আমার চোখ ঘুমায়, কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।
(সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২২৪৮)
হযরত আবু সাইদ খুদরি (রাঃ) বলেন, একবার মক্কার সফরে আমার ও ইবনে সায়্যাদের সাক্ষাত হল। সে আমাকে তার সেই কষ্টের কথা ব্যক্ত করল, যা লোকদের দ্বারা সে পেয়েছিল। বলল, মানুষ আমাকে দাজ্জাল বলে। আবু সাঈদ, তুমি কি রাসুল (সাঃ) কে বলতে শুননি, দাজ্জালের কোন সন্তান হবে না; অথচ আমার একাধিক সন্তান আছে? নবীজি (সাঃ) কি একথা বলেননি যে, দাজ্জাল কাফের হবে, অথচ আমি মুসলমান। তিনি কি একথা বলেননি যে, দাজ্জাল মদীনা ও মক্কায় প্রবেশ করবে না, অথচ আমি মদিনা থেকে এসেছি এবং মক্কায় যাচ্ছি? আবু সাঈদ (রাঃ) বলেন, ইবনে সায়্যাদ আমাকে সর্বশেষ কথাটি এই বলেছে যে, মনে রেখো, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি দাজ্জালের জন্মের সময় ও স্থান সম্পর্কে জানি। সে কোথায় আছে, তাও আমি বলতে পারি। তার পিতামাতাকেও চিনি। আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) বলেন, ইবনে সায়্যাদের এসব কথা শুনে আমি সন্দেহে পড়ে গেলাম। আমি বললাম, তুমি আজীবনের জন্য ধ্বংস হও। সে সময় উপস্থিত লোকদের একজন জিজ্ঞেস করল, তোমার কি এটা পছন্দ হবে যে, তুমিই দাজ্জাল? উত্তরে সে বলল, হ্যাঁ, দাজ্জালের যত গুন আছে, যদি তার সবগুলো আমাকে দেওয়া হয়, তাহলে আমি মন্দ ভাবব না।
(সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২৯২৭)
হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ বলেন, ইবনে সায়্যাদ হাররার ঘটনার সময় অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। পরে আর কোন দিন ফিরে আসেনি।
----
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১৩] ইবনে সায়্যাদ কি দাজ্জাল ছিল?
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইবনে সায়্যাদ সম্পর্কে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেননি। সাহাবা কিরামের মতো পরবর্তী আলেমগনেরও মাঝে এ ব্যাপারে মতভেদ চলতে থাকে। যারা ইবনে সায়্যাদের দাজ্জাল হবার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন, তাদের দলিল হল দাজ্জাল হবে কাফের। সে মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ করবে না এবং তার কোন সন্তান জন্মাবে না। পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস করেন, ইবনে সায়্যাদই দাজ্জাল, তাদের বক্তব্য হল, তার মাঝে সেই সব লক্ষন বিদ্যমান ছিল, যেগুলো নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তার পিতামাতাও ঠিক তেমনই ছিল, যেমনটি নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের সম্পর্কে বলেছিলেন। তাছাড়া ইবনে সায়্যাদ-এর
উক্তি ‘আমি দাজ্জালের জন্মের সময় ও স্থান সম্পর্কে জানি’ এটিও তার নিজের দাজ্জাল হওয়ার প্রমাণ বহন করে। এই পক্ষটি ইবনে সায়্যাদের দাজ্জাল না হওয়ার পক্ষের আলেমগনের দলিলের জবাবে বলেছেন, দাজ্জাল কাফের হবে এ কথা ঠিক। ইবনে সায়্যাদও কাফের ছিল। আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) এর সফরসঙ্গীদের একজন যখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, তুমি কি এটা পছন্দ করবে যে, তুমি দাজ্জাল? সে উত্তর দিয়েছিল, দাজ্জালকে যেসব বিষয় দেওয়া হয়েছে, যদি আমাকেও সে সব দেওয়া হয়, তাহলে আমি দাজ্জাল হওয়া অপছন্দ করব না। তার এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণে দাজ্জাল তখনই ইসলাম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। অবশিষ্ট থাকল, অবশিষ্ট থাকল, মক্কা ও মদিনায় প্রবেশ করা-না-করার বিষয়টি। এপ্রসঙ্গে মুসলিম শরিফের ব্যাখ্যাকার ইমাম নববি বলেছেন,‘তার ইসলাম প্রকাশ করা, হজ্ব করা, জিহাদ করা ও দুঃসময় অবস্থা থেকে মুক্তিলাভের প্রচেষ্টা এসব ক্ষেত্রে তো একথা স্পষ্ট বলা হয়নি যে, সে দাজ্জাল ব্যতীত অন্য কেউ’।
শীর্ষস্থানীয় সাহাবাগনের মধ্যে হযরত ওমর (রাঃ), হযরত আবুজর গিফারি (রাঃ), হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ), হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) ও আরও একাধিক বিশিষ্ট সাহাবা ইবনে সায়্যাদ এর দাজ্জাল হওয়ার প্রবক্তা ছিলেন।ইমাম বুখারি (রহঃ)ও ইবনে সায়্যাদ এর দাজ্জাল হওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। হযরত জাবির (রাঃ), হযরত ওমর (রাঃ) থেকে যে হাদিসটি বর্ণনা করেছেন, তিনি সেটি উল্লেখ করেই ক্ষান্ত হয়েছেন। তামীমদারি সম্পর্কিত হযরত ফাতেমা বিনতে কায়েস (রাঃ) এর হাদিসটি তিনি উল্লেখই করেননি। (ফাতহুল বারী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩২৮)
যে সব আলেম ইবনে সায়্যাদকে দাজ্জাল মানেন না, তাদের দলিল হল হযরত তামীমদারি শীর্ষক হাদিস। হাফিজ ইবনে হাজর ফাতহুল বারীতে এসব আলোচনার পর বলেছেন, তামীমদারি শীর্ষক হাদিস ও ইবনে সায়্যাদ-এর দাজ্জাল হওয়া বিষয়ক হাদিসগুলোর মধ্যে এভাবে সমন্বয় করা যায় যে, তামীমদারি (রাঃ) যাকে বাঁধা অবস্থায় দেখেছিলেন, সে দাজ্জালই ছিল। আর ইবনে সায়্যাদ ছিল শয়তান, যে পুরো সময়টিতে দাজ্জালের রূপ ধারণ করে ইস্ফাহান চলে যাওয়া পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। ওখানে গিয়ে সে তার বন্ধুদেরসহ সেই সময়ের জন্য গা ঢাকা দিয়েছে, যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে আত্মপ্রকাশের শক্তি দান করবেন। (ফাতহুল বারী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩২৮)
তাছাড়া ইবনে হাজর দলিল হিসাবে সেই বর্ণনাটিও উদ্ধৃত করেছেন, তিনি বলেছেন, আমরা যখন ইস্ফাহান জয় করলাম, তখন আমাদের বাহিনী ও ইহুদিয়া নামক পল্লীর মধ্যখানে এক ক্রোশ পথের ব্যবধান ছিল। আমরা ইহুদিয়া যেতাম এবং সেখান থেকে খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি ক্রয় করে আনতাম। ‘একদিন আমি ওখানে গেলাম। দেখলাম, ইহুদীরা নাচছে ও বাজনা বাজাচ্ছে। উক্ত ইহুদীদের মাঝে আমার এক বন্ধু ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এরা নাচ গান করছে কেন? সে বলল, আমাদের যে সম্রাটের মাধ্যমে আমরা আরব বিশ্বকে জয় করব, তিনি আগমন করছেন।তার এই উত্তরে আমার মনে কৌতূহল জেগে গেল। রাতটা আমি তারই কাছে একটি উঁচু স্থানে অতিবাহিত করলাম। পরদিন সকালে যখন সূর্য উদিত হল, তখন আমাদের বাহিনীর দিক থেকে ধূলি উত্থিত হল। আমি এক
ব্যক্তিকে দেখলাম, যার গাঁয়ে রায়হানের কাবা জড়ানো আর ইহুদীরা নাচগানে লিপ্ত। আমি লোকটিকে ভালোমতো দেখলাম। বুঝে ফেললাম, লোকটি ইবনে সায়্যাদ। পরক্ষনে সে ইহুদিয়া পল্লীতে ঢুকে গেল এবং পরে এ পর্যন্ত আর ফিরে আসেনি’।(ফাতহুল বারী, খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা ৩৩৭)
আলোচনাটি এখানেই শেষ করছি। যেহেতু রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শেষ পর্যন্ত এ ব্যাপারে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেননি, তাই বলতে হচ্ছে, প্রকৃত সত্য আল্লাহই জানেন।এভাবে রহস্য লুকায়িত রাখার মধ্যে মহান আল্লাহর অনেক তাৎপর্য থাকে, যা সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য কল্যাণের কারণ হয়ে থাকে।
----
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১৪] দাজ্জালের সামনে সন্তান হল পরীক্ষা
হযরত ইমরান ইবনে হুদাইর (রহঃ) আবু মুজলিজ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন, আবু মুজলিজ (রহঃ) বলেছেন, যখন দাজ্জালের আবির্ভাব ঘটবে, তখন মানুষ তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। একটি দল তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। একটি দল যুদ্ধের ময়দান থেকে পালিয়ে যাবে। একদল মানুষ তার সাথে যোগ দেবে। যে ব্যক্তি চল্লিশ রাত তার সাথে পাহাড়ের চূড়ায় তার সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকবে, সে আল্লাহর পক্ষ থেকে জীবিকা প্রাপ্ত হবে। যে সব নামাজী দাজ্জালের সহযোগীতে পরিণত হবে, তাদের অধিকাংশ সন্তান-সন্ততির জনক জননী হবে। তারা বলবে, আমরা দাজ্জালের গোমরাহি সম্পর্কে ভালভাবেই জানি। কিন্তু এর থেকে আত্মরক্ষা কিংবা এর সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ঘর বাড়ি পরিত্যক্ত করতে পারি না। তো যারা এই নীতি অবলম্বন করবে, তারাও দাজ্জালের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। দাজ্জালের জন্য দুটি ভূমিকে অনুগত বানিয়ে দেওয়া হবে। একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের শিকার ভূমি, যাকে সে বলবে, এটি জাহান্নাম। অপরটি সবুজ শ্যামল ভূমি, যাকে সে বলবে, এটি জান্নাত। ঈমানওয়ালাদের আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষা করা হবে। অবশেষে এক মুসলমান বলবে, এই পরিস্থিতি আমি সহ্য করতে পারব না। আমি সেই লোকটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব, যে মনে করছে, সে আমার রব। যদি প্রকৃতই সে আমার রব হয়, তা হলে আমি তার উপর জয়ী হতে পারব না। তবে এখন আমি যে অবস্থায় আছি, তার থেকে আমি মুক্তি পাব ( অর্থাৎ আমি তার কাছে পরাজিত হব, সে আমাকে হত্যা করে ফেলবে, আর আমি যে বিপজ্জনক অবস্থায় নিপাতিত আছি, তার থেকে রেহাই পেয়ে যাব)।
উক্ত মুসলমান তাকে বলবে, তুমি আল্লাহকে ভয় কর; এতো মস্ত এক বিপদ। এভাবে সে দাজ্জালের সঙ্গে বিদ্রোহের ঘোষণা দেবে এবং তার দিকে এগিয়ে যাবে। লোকটি দাজ্জালকে গভীরভাবে নিরীক্ষা করার পর তার বিরুদ্ধে গোমরাহি, কুফর ও মিথ্যার সাক্ষ্য প্রদান করবে। শুনে দাজ্জাল (তাচ্ছিল্যের সঙ্গে) বলবে, দেখো ব্যাপারটা; যাকে আমি সৃষ্টি করলাম ও পথের দিশা দিলাম, সে কিনা আমাকে মন্দ বলছে! লোক সকল, তোমরা কি মনে করছ, আমি যদি হত্যা করি, পরে আবার জীবিত করি, তাহলে এরপরও তোমরা আমার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করবে কি? জনতা বলবে, না। এবার দাজ্জাল যুবকের গাঁয়ে একটি আঘাত হানবে, যার ফলে তার দেহটি দুই খণ্ডে বিভক্ত হয়ে যাবে। তারপর আঘাত করবে, এবার সে জীবিত হয়ে যাবে। এর ফলে ঈমানওয়ালার ঈমান আরও বেড়ে যাবে এবং সে দাজ্জালের বিরুদ্ধে কুফর ও মিথ্যার সাক্ষ্য প্রদান করবে। এই যুবক ব্যতীত দাজ্জালের আর কাউকে হত্যা করে জীবিত করার ক্ষমতা থাকবে না। পরে দাজ্জাল বলবে, দেখো, আমি একে হত্যা করে আবার জীবিত করেছি, কিন্তু তারপরও এ আমাকে মন্দ বলছে। বর্ণনাকারী বলেন, দাজ্জালের কাছে একটি ছুরি থাকবে। সে মুসলমান যুবককে সেটি দ্বারা কাটতে চাইবে। কিন্তু তামা তার ও ছুরির মাঝে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়াবে। ছুরি মুসলমান যুবকের উপর কোন ক্রিয়াই করবে না। অনন্তর দাজ্জাল যুবককে ধরে তুলবে এবং বলবে, একে আগুনে নিক্ষেপ কর। ফলে তাকে সেই দূর্ভিক্ষকবলিত ভূমিতে নিক্ষেপ করা হবে, যাকে দাজ্জাল আগুন মনে করবে। অথচ বাস্তবে সেটি হবে জান্নাতের দরজাসমূহের একটি দরজা। আল্লাহ মুমিন যুবককে জান্নাতে পৌছিয়ে দেবেন।
(আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ১১৭৮)
কিছু নামাজী মুসলমানও সন্তান সন্ততির কারণে দাজ্জালের সঙ্গ দিতে বাধ্য হবে। মহান আল্লাহ সন্তানকে পরীক্ষা সাব্যস্ত করেছেন। মূলনীতি হল, পরীক্ষার জন্য আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। কাজেই যে সব দ্বীনদার লোক ঈমানের অবস্থায় আপন রবের সঙ্গে মিলিত হওয়ার আশা রাখে, তাদের উচিত এখন থেকেই এই বিষয়টির অনুশীলন করা যে, আল্লাহর জন্য সন্তানদের পরিত্যাগ করতে পারবে কিনা। এই প্রস্তুতির সহজ পদ্ধতি হল, তারা সেই পথে যেতে প্রস্তুত হয়ে যাক, যে পথ সম্পর্কে সাধারণ ধারণা হল, ওখানে গেলে আর ফেরত আসা যায় না কিংবা যে ব্যক্তি ওখানে যায়, সে মৃত্যুবরণ করে। নিজেও বারবার এর অনুশীলন করুন এবং স্ত্রী-সন্তানদেরও এর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করুন। এই পদ্ধতি অবলম্বন করলে গোটা পরিবার পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হয়ে যাবে এবং আল্লাহর সাহায্যে দাজ্জালের সময় নিজের দ্বীন ও ঈমান বাচানোর জন্য যে কোন কুরবানি দিতে প্রস্তুত হয়ে যাবে। দাজ্জালের কুফরি দেখে বহু মানুষ নীরব দর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। এক যুবক সে সব সহ্য করতে ব্যর্থ হবে এবং দাজ্জালের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে বসবে। তথাকথিত ‘শান্তিকামী সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীবী’-রা তাকে বোঝাবেন, তুমি এমনটি কর না; বরং বাস্তবতাকে উপলব্ধি করে সে অনুপাতে কাজ করো। কিন্তু কিছু হৃদয়ের সম্পর্ক আল্লাহর আরশের সঙ্গে জুড়ে যায়, তারা পাগল হয়ে যায় এবং যে কোন তাগুতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করাই তাদের ধর্মে পরিণত হয়ে যায়। এই যুবকও দাজ্জালের কুফরিকে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করে বসবে ।
----
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১৫] দাজ্জালের অর্থনৈতিক প্যাকেজ
হযরত ওবায়েদ ইবনে উমায়ের আল-লায়াছি বলেছেন, দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে। তখন কিছু মানুষ তার অনুসারী হয়ে যাবে। তারা বলবে, আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি, দাজ্জাল নিঃসন্দেহে কাফের; তবে তার খাদ্য ভাণ্ডার থেকে খেতে এবং তার বাগানে পশুপাল চড়াতে তার অনুসারী হয়েছি। পরবর্তী সময়ে যখন আল্লাহর গজব নাজিল হবে, তা তাদের সকলের উপর নাজিল হবে।
(আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৪৬)
আজ মুসলমান এই হাদিসগুলোতে চিন্তা করে না। যদি আমরা চিন্তা করি, তা হলে গোটা সুরতহাল স্পষ্ট হয়ে যাবে। আজও কি এমনটি হচ্ছে না যে, বাতিলের পরিচয় জানা সত্বেও অর্থনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মুসলমান বাতিলের সঙ্গ দিচ্ছে, বাতিলকে সহযোগিতা দিচ্ছে কিংবা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে?
হযরত শাহ্র ইবনে হাওশাব (রাঃ), আসমা বিনতে যায়ীদ আনসারিয়া থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আসমা (রাঃ) বলেছেন, একদিন নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার ঘরে অবস্থানরত ছিলেন। তখন তিনি দাজ্জাল সম্পর্কে কিছু কথা বললেন। তিনি বলেছেন, তার ফেতনাসমূহের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ফেতনাটি এই হবে যে, সে এক গ্রাম্য লোকের নিকট আসবে এবং বলবে, তোমার খেয়াল কি; আমি যদি তোমার মৃত উটটি জীবিত করে দেই, তাহলে কি তুমি মেনে নিবে আমি তোমার রব? গ্রাম্য লোকটি বলবে, হ্যাঁ। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তারপর শয়তানরা তার মৃত উটটিকে ঠিক আগের মতো বরং তার চেয়েও উত্তম – যেমন দুগ্ধদায়িনী ভরাপেট ছিল – বানিয়ে দিবে। অনুরূপভাবে দাজ্জাল এমন এক ব্যক্তির নিকট আসবে, যার পিতা ও ভাই মারা গেছে। তাকে বলবে, তোমার ধারণা কি; আমি যদি তোমার বাপ ভাইকে জীবিত করে দেই, তাহলে কি তুমি মেনে নিবে আমি তোমার রব? উত্তরে সে বলবে, কেন নয়। ফলে, তারপর শয়তানরা লোকটির পিতা ভাইয়ের আকৃতিতে এসে হাজির হবে। এ পর্যন্ত বলে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোন এক কাজে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষন পর ফিরে এলেন। তখন লোকেরা এঘটনায় বিষণ্ণ ও বিচলিত ছিল। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দরজার চৌকাঠ দুটো ধরে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং বললেন, কি হয়েছে আসমা? উত্তরে আসমা (রাঃ) বললেন, দাজ্জালের আলোচনা করে আপনি আমাদের কলিজাটা বের করে দিয়েছেন। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ও যদি আমার জীবদ্দশায় আত্মপ্রকাশ করে, তা হলে আমি তার জন্য বাঁধা হয়ে যাব। অন্যথায় আমার রব প্রতিজন মুমিনের হেফাজতকারী হবেন। তারপর আসমা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা যখন আটা খামির করি, তখন ততক্ষণ পর্যন্ত রুটি তৈরি করি না, যতক্ষণ না আমদের ক্ষুধা লাগে। তো সে সময় ঈমানদারদের অবস্থা কি হবে? উত্তরে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তাদের জন্য সেই তসবীহ তাহমীদই যথেষ্ট হবে, যা আকামের অধিবাসীদের জন্য যথেষ্ট হয়ে থাকে।
(আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৩৫)
এই বর্ণনাটি ইমাম আহমাদও বর্ণনা করেছেন। তবে উভয় বর্ণনায় শব্দের কিছু তারতম্য আছে। তাতে অতিরিক্ত এই কথাটিও আছে যে, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যারা আমার মজলিসে উপস্থিত হয়েছ এবং আমার বক্তব্য শুনেছ, তোমরা এই কথাগুলোকে সেই লোকদেরও কানে পৌঁছিয়ে দিও, যারা এই মজলিসে উপস্থিত নেই’।মুসনাদে তায়ালিসিতে এই বর্ণনাটি শাহ্র ইবনে হাওশাব এর সনদ ব্যতীত অন্য সনদে উল্লেখিত হয়েছে। আবু উমামা থেকে বর্ণিত দীর্ঘ হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“দাজ্জাল বেদুইনের কাছে এসে বলবে- “ওহে বেদুইন! আমি যদি তোমার মৃত পিতা-মাতাকে জীবিত করে দিই, তবে আমাকে প্রভু বলে মেনে নিতে তোমার কোন আপত্তি থাকবে? বেদুইন বলবে- না!! অতঃপর দু’-জন শয়তান তার পিতা-মাতার রূপ ধরে তাকে বলবে- ওহে বৎস! একে অনুসরণ কর! সে তোমার প্রভু!”
(ইবনে মাজাহ # ৪০৬৭, সহিহ আল-জামি আল-সগীর # ৭৭৫২, মুস্তাদরাকে হাকিম)
হযরত হুজায়ফা (রাঃ) দাজ্জাল বিষয়ক বর্ণনা উদ্ধৃত করার পর বলেছেন, নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,“আমি এ বিষয়টি বারবার এজন্য বর্ণনা করছি, যেন তোমরা বিষয়টিতে গভীর মনোযোগ সহকারে চিন্তা গবেষণা কর, সজাগ সচেতন হও, সে মোতাবেক কাজ কর এবং বিষয়টি তোমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে আলোচনা কর। কারণ, দাজ্জালের ফেতনা ভয়াবহতম একটি ফেতনা"।
(আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান)
----
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১৬] দাজ্জালের বাহন ও তার গতি
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “দাজ্জালের গাধার (বাহনের) মাঝে চল্লিশ গজের দূরত্ব থাকবে এবং এক একটি পদক্ষেপ তিনদিনের ভ্রমণের সমান হবে। সে তার গাধার পিঠে আরোহণ করে সমুদ্রে এমনভাবে ঢুকে যাবে, যেমন তোমরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে পানির ছোট নালায় ঢুকে থাক (এবং নালা পার হয়ে থাক)। সে দাবি করবে, আমি বিশ্বজগতের রব এবং সূর্যটা আমার কথা মত চলছে। তোমরা কি চাচ্ছ যে আমি একে থামিয়ে দেই? তার কথায় সূর্য থেমে যাবে। এমনকি একটি দিন মাস ও সপ্তাহের সমান হয়ে যাবে। এবার সে বলবে, তোমরা কি চাচ্ছ, আমি এটিকে আবার চালিয়ে দেই? লোকেরা বলবে, হ্যাঁ দিন। তখন দিন ঘণ্টার সমান হয়ে যাবে। তার কাছে এক মহিলা আসবে এবং বলবে, হে আমার রব, আপনি আমার পুত্র এবং স্বামীকে জীবিত করে দিন। তখন শয়তানরা মহিলার পুত্র ও স্বামীর আকৃতিতে এসে হাজির হবে। মহিলা শয়তানকে গলায় জড়িয়ে ধরবে এবং তার সাথে যৌনকর্মে লিপ্ত হবে। মানুষের ঘরগুলো শয়তানদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যাবে।
এক গ্রাম্যলোক দাজ্জালের নিকট আসবে এবং বলবে, হে আমাদের রব, আপনি আমাদের জন্য আমাদের উট ও বকরিগুলোকে জীবিত করে দিন। দাজ্জাল তাদেরকে উট- বকরির আকৃতিতে কতগুলো শয়তান দিয়ে দেবে। এই পশুগুলো ঠিক সেই বয়স ও সেই শরীর স্বাস্থ্যের হবে, যেমনটি তাদের মৃত উট বকরিগুলো ছিল। এসব দেখে গ্রামের অধিবাসীরা বলবে, ইনি যদি আমাদের রব না হতেন, তাহলে আমাদের মৃত উট বকরিগুলোকে কোনক্রমেই জীবিত করতে পারতেন না। দাজ্জালের সঙ্গে ঝোল ও গোশতওয়ালা হাড়ের পাহাড় থাকবে, যেগুলো সব সময় গরম থাকবে – কখনও ঠাণ্ডা হবে না। আর প্রবাহমান নহর থাকবে। একটি পাহাড় থাকবে বিভিন্ন ফল ও সবজির বাগানের। একটি পাহাড় থাকবে আগুন ও ধোঁয়ার। সে বলবে, এটি আমার জান্নাত আর এটি আমার জাহান্নাম। এগুলো আমার খাদ্য এবং এগুলো আমার পানীয়। হযরত ঈসা (আঃ) তাঁর সঙ্গে থাকা লোকদের লোকদেরকে সতর্ক করবেন যে, এই লোকটিই মিথ্যাবাদী দাজ্জাল। আল্লাহ তাঁর উপর লা’নত বর্ষণ করুন। তোমরা তার কবল থেকে বেঁচে থাকো। আল্লাহ ঈসা (আঃ) কে অনেক তীব্র গতি দান করবেন। ফলে দাজ্জাল তাঁর নাগাল পাবে না। তো দাজ্জাল যখন বলবে, আমি সমগ্র জগতের রব, তখন মানুষ বলবে তুমি মিথ্যাবাদী। উত্তরে হযরত ঈসা (আঃ) বলবেন, মানুষ সত্য কথা বলেছে। তারপর ঈসা (আঃ) মক্কার দিকে আসবেন। সেখানে তিনি বড় এক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত পাবেন। তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কে?
তিনি উত্তর দেবেন, আমি মিকাঈল; দাজ্জালকে হারাম শরীফ থেকে দূরে রাখার জন্য আল্লাহ আমাকে প্রেরন করেছেন। তারপর ঈসা (আঃ) মদিনার দিকে আসবেন। সেখানেও তিনি বড় এক ব্যক্তিত্বের সাক্ষাত পাবেন। তাকে জিজ্ঞেস করবেন, আপনি কে? তিনি উত্তর দেবেন, আমি জিব্রাঈল; দাজ্জালকে রাসুলের হারাম থেকে দূরে রাখার জন্য আল্লাহ আমাকে প্রেরন করেছেন। এবার দাজ্জাল মক্কার দিকে অগ্রসর হবে। এসে যখন মিকাঈল (আঃ) কে দেখবে, সঙ্গে সঙ্গে পিঠ দেখিয়ে পালিয়ে যাবে এবং পবিত্র হারাম শরীফে ঢুকতে ব্যর্থ হবে। তবে সে বিকট সব্দে একটি চিৎকার দেবে, যার ফলে প্রতিজন মুনাফিক নারী ও মুনাফিক পুরুষ মক্কা থেকে বেরিয়ে দাজ্জালের কাছে চলে যাবে। তারপর দাজ্জাল মদিনার দিকে আসবে। কিন্তু যখন জিব্রাঈলকে দেখবে, সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যাবে। কিন্তু সেখানেও সে সজোরে একটা চিৎকার দেবে। সেই চিৎকার শুনে প্রতিজন মুনাফিক পুরুষ ও মুনাফিক নারী মদিনা থেকে বের হয়ে তার কাছে চলে যাবে। এক তথ্যসরবরাহকারী মুসলমান মুসলমানদের এই দলটির কাছে আসবে, যারা কুনুস্তুনিয়া (বর্তমান ইস্তাম্বুল) জয় করেছে এবং যাদের সঙ্গে সাথে বাইতুল মুকাদ্দাসের মুসলমানদের সম্প্রীতি থাকবে। বলবে, অচিরেই দাজ্জাল তোমাদের কাছে এসে পৌঁছাবে। শুনে তারা বলবে, আসুক, আমরা তার সঙ্গে যুদ্ধ করব। তুমিও আমাদের সঙ্গে থাকো। দূত বলবে, না, আমাকে অন্যদেরও সংবাদটা পৌঁছুতে হবে। কিন্তু এই লোকটি যখন ফেরত রওনা হবে, তখন দাজ্জাল তাকে ধরে ফেলবে এবং বলবে, এই সেই লোক, যে মনে করে, আমি তাকে কাবু করতে পারবো না। নাও একে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলো। এই মুসলিম দূতকে করাত দ্বারা চিড়ে ফেলা হবে। তারপর দাজ্জাল (জনতাকে উদ্দেশ্য করে) বলবে, আমি যদি এই লোকটিকে তোমাদের সামনে জীবিত করে দেই, তাহলে কি তোমরা বিশ্বাস করবে, আমি তোমাদের রব? জনতা বলবে, আমরা তো আগে থেকেই জানি, আপনি আমাদের রব। তারপরও এই বিশ্বাসটিকে পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে দাজ্জাল লোকটিকে জীবিত করে তুলবে। লোকটি আল্লাহর ইচ্ছায় দাঁড়িয়ে যাবে। কিন্তু মহান আল্লাহ এই লোকটি ব্যতীত আর কারও ক্ষেত্রে দাজ্জালকে এই শক্তি দেবেন না যে, কাউকে হত্যা করে সে আবার তাকে জীবিত করবে। তারপর দাজ্জাল মুসলমান দূতকে বলবে, আমি কি তোমাকে হত্যা করে জীবিত করিনি? কাজেই আমি তোমার রব। উত্তরে দূত বলবে, এখন তো আমি আরও নিশ্চিত হয়েছি যে, আমিই সেই ব্যক্তি, যাকে নবীজি (সাঃ) সুসংবাদ দিয়েছেন যে, তুমি আমাকে হত্যা করবে এবং পরে আল্লাহর ইচ্ছায় জীবিত করবে। আর আল্লাহ আমাকে ব্যতীত আর কাউকে পুনরায় জীবিত করবেন না। তারপর উক্ত দূতের গাঁয়ে তামার চাদর জড়িয়ে দেওয়া হবে, যার ফলে দাজ্জালের কোন অস্ত্র তার উপর ক্রিয়া করবে না। না তরবারি, না ছুরি, না পাথর, না অন্য কোন অস্ত্র। ফলে দাজ্জাল বলবে, একে আমার জাহান্নামে নিক্ষেপ করো। আল্লাহ দাজ্জালের আগুনের পর্বতটিকে সবুজ শ্যামল বাগিচায় পরিণত করে দেবেন (কিন্তু দর্শকরা মনে করবে, ওকে আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করা হয়েছে)। মানুষ সংশয়ে নিপাতিত হবে। তারপর দাজ্জাল দ্রুত বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে এগিয়ে যাবে। যখন সে আফীকের চূড়ায় আরোহণ করবে, তখন তার ছায়া মুসলমানদের উপর পতিত হবে। (ফলে মুসলমানরা তার আগমন টের পেয়ে যাবে) সঙ্গে সঙ্গে মুসলমানরা তার সঙ্গে যুদ্ধ করতে তাদের ধনুকগুলোকে ঠিকঠাক করে নেবে। (সেই দিনটি এত কঠিন হবে যে), সেদিন সেই মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী মনে করা হবে, যারা ক্ষুধা ও দুর্বলতার কারণে (বিশ্রামের লক্ষ্যে) সামান্য সময়ের জন্য থেমে যাবে রা বসে পড়বে। (অর্থাৎ যত শক্তিশালী যোদ্ধাই হোক, ঘোরতর যুদ্ধ লড়ার কারণে সামান্য সময়ের জন্য হলেও সে বিশ্রাম নিতে বাধ্য হবে)। এই অবস্থায় মুসলমানরা ঘোষণা শুনবে – লোকসকল, তোমাদের কাছে সাহায্য (হযরত ঈসা ইবনে মারিয়াম) এসে পড়েছে”।
(আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৪৩)
দাজ্জালের এক একটি পদক্ষেপ তিনদিনের সফরের সমান হবে। হিসাব করে পাওয়া গেছে, এই পরিমাণটা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৮২ কিলোমিটার। ঘণ্টায় ২ লাখ ৬৫ হাজার ২ শত কিলোমিটার। হিসাবটা এভাবে বের করা হয়েছে যে, তিন দিনের শরয়ী সফর হল ৪৮ মাইল। ৪৮ মাইলে ৮২ কিলোমিটার। এই হিসাবের অর্থ দাঁড়ায়, দাজ্জাল সেকেন্ডে ৮২ কিলোমিটার গতিতে ভ্রমণ করবে। মুসলিম শরীফে নাওয়াস ইবনে সাম’আন এর বর্ণনায় দাজ্জালের গতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যেন সেই বৃষ্টি, বায়ু যাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়’। ‘আফীক’ একটি পাহাড়ি সড়কের নাম, যেখানে জর্ডান নদী তারবিয়া উপসাগর থেকে বের হয়েছে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল এই অঞ্চলটির দখল হাতে নিয়েছিল। ‘আফীক’ এর আরেক নাম আছে ‘এমটি পিটার্স’। বাইবেলের ভাষ্য মোতাবেক ‘আফীক’ সেই জায়গা, যেখানে হযরত ঈসা (আঃ) ব্যাপ্টিজম গ্রহণ করেছিলেন এবং ব্যাপ্টিজমের জন্য বহু মানুষ গিয়ে থাকে’।
(এন্সাইক্লোপেডিয়া অফ ব্রিটেনিকা)
হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) বর্ণনা করেন “দাজ্জালের গাধার কানগুলো এত বড় হবে যে, সত্তর হাজার মানুষ তার তলে ছায়া গ্রহণ করতে পারবে”।
( আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৪৮)
হযরত কা’ব (রাঃ) বর্ণনা করেন, “দাজ্জাল যখন উর্দুনে (জর্ডানে) আসবে, তখন তূর পাহাড়, ছাওর পাহাড় ও জুদি পাহাড়কে ডাকবে। এমনকি এই তিনটি পাহাড় পরস্পর এমনভাবে সংঘাতে লিপ্ত হবে, যেমন দুটি ষাঁড় কিংবা ছাগল পরস্পর সংঘর্ষে লিপ্ত হয়”।
( আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৩৭)
----
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১৭] দাজ্জাল কখন আত্মপ্রকাশ করবে?
হযরত মু’আয ইবনে জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “বাইতুল মাকদিসের আবাদ হওয়া মদিনার ক্ষতির কারণ হবে। মদিনার ক্ষতি মহাযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরি করবে। মহাযুদ্ধ কুস্তুন্তুনিয়ার (ইস্তাম্বুলের) বিজয়ের কারণ হবে। কুস্তুন্তুনিয়ার বিজয় দাজ্জালের আবির্ভাবের কারণ হবে”।
বর্ণনাকারী বলেন, তারপর আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই হাদিসের বর্ণনাকারীর (অর্থাৎ - স্বয়ং তাঁর) উরুতে কিংবা কাঁধের উপর চাপড় মেরে বললেন, “তোমার এই মুহূর্তে এখানে উপবিষ্ট থাকার বিষয়টি যেমন সত্য, আমার এই বিবরণও তেমনই বাস্তব”।
(সুনানে আবী দাউদ, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ১১০; মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ২৪৫; মুসান্নাফে ইবনে আবী শায়বা)
‘বাইতুল মুকাদ্দাসের আবাদ হওয়া’ দ্বারা উদ্দেশ্য ওখানে ইহুদীদের শক্তি প্রতিষ্ঠা হওয়া। সেই ঘটনাটি ঘটে গেছে। এখন ইহুদীদের নাপাক দৃষ্টি পবিত্র মদিনার উপর নিবদ্ধ। উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনাদের আরব দ্বীপে আগমন প্রকৃতপক্ষে সেই পরিকল্পনারই একটি অংশ, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। কিন্তু প্রকৃত ঈমানদারগণ ইহুদীদের এই ষড়যন্ত্র বঝে ফেলেছে। এভাবে তখন থেকে শুরু হওয়া কুফর ও ইসলামের লড়াই এখন দ্রুতগতিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তমূলক পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে বুসর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মহাযুদ্ধ ও কুস্তুন্তুনিয়া (ইস্তাম্বুল) জয়ের মধ্যখানে সময় যাবে ছয় বছর। সপ্তম বছরে দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে”।
(ইবনে মাজা, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ১৩৭)
মহাযুদ্ধ ও কুস্তুন্তুনিয়া (ইস্তাম্বুল) জয় সম্পর্কে দুটি বর্ণনা এসেছে। এক বর্ণনায় ছয় মাসের ব্যবধানের কথা বলা হয়েছে। অপর বর্ণনায় ছয় বছর। তবে আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানি ফাতহুল বারীতে মন্তব্য করেছেন, সনদের দিক থেকে ছয় বছর বিষয়ক বর্ণনাটি অধিক বিশুদ্ধ।
(ফাতহুল বারী, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ২৭৮)
তাছাড়া আবু দাউদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ আওনুল মা’বুদে মোল্লা আলী কারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন যে, ‘মহাযুদ্ধ ও দাজ্জালের আবির্ভাবের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান বিষয়ে সাত মাসসংক্রান্ত বর্ণনার তুলনায় সাত বছরবিষয়ক বর্ণনা অধিক বিশুদ্ধ’। অর্থাৎ মহাযুদ্ধ ও দাজ্জালের আবির্ভাবের মধ্যকার সময়ের ব্যবধান ছয় বছর। সপ্তম বছরে দাজ্জাল
আবির্ভূত হবে।
(আওনুল মা’বুদ, খণ্ড ১১, পৃষ্ঠা ২৭২)
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “তোমরা কি এমন কোন নগরীর নাম শুনেছ, যার একদিকে বন আর অন্যদিকে নদী?” সাহাবাগণ বললেন, হ্যাঁ, শুনেছি, হে আল্লাহর রাসুল। আল্লাহর রাসুল সাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “ততক্ষণ পর্যন্ত কেয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না ইসহাক বংশের সত্তর হাজার সেনা উক্ত নগরীর সঙ্গে যুদ্ধ করবে। তারা এই নগরীতে এসে আত্মপ্রকাশ করবে। কিন্তু তারা কোন অস্ত্র দ্বারাও যুদ্ধ করবে না এবং একটি তীরও ছুড়বে না। তারা বলবে, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ আর অমনি নগরীর দুই দিককার প্রাচীরের একদিক ভেঙ্গে পড়বে। তারপর তারা দ্বিতীয়বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ বলবে আর অমনি অপর দিককার প্রাচীরও খসে পড়বে। তারপর তারা তৃতীয়বার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’ বলবে আর অমনি তাদের জন্য প্রশস্ত পথ তৈরি হয়ে যাবে। তারা সেই পথে নগরীতে প্রবেশ করবে। তারা মালে গনিমত অর্জন করবে। এই মালে গনিমত বণ্টনে তারা আত্মনিয়োগ করবে। হঠাৎ একটি আওয়াজ কানে আসবে যে, কেউ একজন ঘোষণা করবে, দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করেছে। ফলে তারা সবকিছু ফেলে রেখে (দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করতে) ফিরে যাবে”।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৩৮)
এই হাদিসে যে নগরীর কথা বলা হয়েছে, সেটি হল কুস্তুন্তুনিয়া বা ইস্তাম্বুল। দাজ্জাল সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, সে কোন একটি কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। হতে পারে, যখন মহাযুদ্ধের কারণে কুফরি শক্তির পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যাবে, তখন তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে এবং পরাজিত কুফরি শক্তিগুলো তার নেতৃত্বে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাবে।
----
[চূড়ান্ত পরীক্ষাঃ ১৮] দাজ্জালের মহাযুদ্ধ ও তাকে হত্যা
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন,“পৃথিবীর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মানুষের মহাযুদ্ধ পাঁচটি। তার দুটি ইতিপূর্বে এই উম্মতের আগে বিগত হয়েছে। অবশিষ্ট তিনটি এই উম্মতের মাঝে সংঘটিত হবে। একটি হল তুর্কি মহাযুদ্ধ। একটি রোমানদের (খ্রিস্টিয়ানদের) সঙ্গে মহাযুদ্ধ। আর তৃতীয়টি হল, দাজ্জালের মহাযুদ্ধ। দাজ্জালের পর আর কোন মহাযুদ্ধ হবে না”।
(আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৫৪৮, আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে একটি পক্ষের নেতৃত্বে ছিল ইসলামী খেলাফতের সর্বশেষ কর্ণধার তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্য। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তাদের পরাজয়ের পর, ঈমানের দুর্বলতা আর ইহুদী খ্রিষ্টানদের উস্কে দেওয়া আরব জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণে ১৯২৪ সালে তুরস্কের অটোম্যান সাম্রাজ্যের অধীন খেলাফত শাসনের বিলুপ্তির মাধ্যমে মুসলমানদের ইসলামী শাসননীতি খেলাফতের যা অবশিষ্ট ছিল তারও বিলুপ্তি ঘটে। কুস্তুন্তুনিয়া বা ইস্তাম্বুলের ভূমি থেকে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা তথা ইসলামের পরাজয় ঘটে। কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় কট্টর ধর্ম নিরপেক্ষতাবাদ নামক কুফরি মতবাদের জয় হয়, যা এখনও বিদ্যমান। রোমানদের (খ্রিস্টিয়ানদের) সঙ্গে এই উম্মতের যে মহাযুদ্ধ হবে তার নেতৃত্ব দিবেন ইমাম মেহেদী। আর দাজ্জালের সাথে যে মহাযুদ্ধ হবে তার নেতৃত্ব দিবেন ঈসা ইবনে মারিয়ম (আঃ)। যদিও মুসলিম জাতি নিজেদের অলসতা ও অবহেলার কারণে আগত এক অনিবার্য বাস্তবতার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছে না, তবে কুফরি শক্তি ঠিকই এর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং স্পষ্ট ভাষায় তার ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছে।
হযরত আবু জায়িরা বর্ণনায় বলেন, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর নিকট দাজ্জালের আলোচনা উত্থাপিত হলে তিনি বললেন,“তার আবির্ভাবের সময় মানুষ তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়বে। একদল তার অনুগামী হয়ে যাবে। একদল অভিভাবকের ভূমিকা নিয়ে পরিজনের সাথে ঘরে বসে থাকবে। একদল এই ফোরাতের তীরে এসে শক্তপায়ে দাঁড়িয়ে যাবে। দাজ্জাল তাদের সাথে যুদ্ধ করবে আর তারা দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। এমনকি তারা শামের (সিরিয়া, জর্ডান, লেবানন, প্যালেস্টাইন ও দখলকৃত প্যালেস্টাইন নিয়ে গঠিত বিস্তীর্ণ অঞ্চল) পশ্চিমাঞ্চলে লড়াই করবে। তারা একটি সেনা ইউনিট প্রেরণ করবে, যাদের মাঝে চিত্রা বা ডোরা বর্ণের ঘোড়া থাকবে। এরা ওখানে যুদ্ধ করবে। ফল এই দাঁড়াবে যে, এদের একজনও ফিরে আসবে না”।
(মুসতাদরাকে হাকেম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৬৪১)
হযরত নাফে’ ইবনে উকবা (রাঃ) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “ আমার অবর্তমানে তোমরা তোমরা জাজিরাতুল আরবে যুদ্ধ করবে। ফলে আল্লাহ এই অঞ্চলটিকে বিজিত করবেন। তারপর তোমরা পারস্যে যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তাকেও বিজিত করবেন। তারপর তোমরা রোমানদের সাথে যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তাকেও বিজিত করবেন। তারপর তোমরা দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তাকেও বিজিত করবেন”।
(সহিহ মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২২৫; সহিহ ইবনে হিব্বান, পৃষ্ঠা ৬৬৭২)
হযরত নাহীক ইবনে সারীম (রাঃ) বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “নিঃসন্দেহে তোমরা মুশরিকদের (মূর্তিপূজারীদের) সঙ্গে যুদ্ধ করবে। এমনকি এই যুদ্ধে তোমাদের বেঁচে যাওয়া মুজাহিদরা উর্দুন (জর্ডান) নদীর তীরে দাজ্জালের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হবে। এই যুদ্ধে তোমরা পূর্ব দিকে অবস্থান গ্রহণ করবে আর দাজ্জালের অবস্থান হবে পশ্চিম দিকে”।
(আল ইসাবা, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪৭৬)
এখানে মুশরিকদের দ্বারা উদ্দেশ্য উপমহাদেশের মূর্তিপূজারী জাতি। তার মানে এটি সেই যুদ্ধ – “গাজওয়াতুল হিন্দ”, যেখানে মুজাহিদরা এই উপমহাদেশে আক্রমণ চালাবে, আল্লাহ তাদেরকে বিজয় দান করবেন, ক্ষমা করে দেবেন, বেঁচে যাওয়া মুজাহিদরা জেরুজালেমে ফিরে যাবে এবং সেখানে ঈসা (আঃ) সাক্ষাত পাবে এবং ঈসা (আঃ) নেতৃত্বে দাজ্জালের বিরুদ্ধে মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।
( সুনানে নাসায়ী, খণ্ড ৬, পৃষ্ঠা ৪২; আল ফিতান, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪০৯ ও ৪১০)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) বলেছেন, “সমুদ্রের শহীদান, আন্তাকিয়ার-আমাকের শহীদান ও দাজ্জালের শহীদান হল মহান আল্লাহর নিকট শ্রেষ্ঠতম শহীদ”।
(আল ফিতান, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ৪৯৩)
এসব যুদ্ধের শহীদদের সম্পর্কে এক বর্ণনায় আরও বলা হয়েছে, “উক্ত যুদ্ধে যে এক তৃতীয়াংশ লোক শহীদ হবে, তাদের এক একজন বদরি শহীদদের দশজনের সমান হবে। বদরের শহীদদের একজন সত্তরজনের জন্য সুপারিশ করবে। পক্ষান্তরে এই ভয়াবহ যুদ্ধগুলোর একজন শহীদ সাতশো ব্যক্তির সুপারিশের অধিকার লাভ করবে”।
(আল ফিতান, খণ্ড ১, পৃষ্ঠা ৪১৯)
তবে মনে রাখতে হবে, এটি একটি শানগত মর্যাদা। অন্যথায় মোটের উপর বদরি শহীদদের মর্যাদা ইতিহাসের সকল শহীদের মাঝে সবচেয়ে উঁচু। রোমানদের (খ্রিস্টিয়ানদের) সঙ্গে এই উম্মতের যে মহাযুদ্ধ হবে তার নেতৃত্ব দিবেন ইমাম মেহেদী। এই মহাযুদ্ধের বিজয়ের পর তিনি আবারও নব্যুওতের আদলে খেলাফত প্রতিষ্ঠা করবেন যার আমিরুল মুমিনিন হবেন তিনি নিজেই। আর এই মহাযুদ্ধের বিজয় কুস্তুন্তুনিয়া (ইস্তাম্বুল) বিজয়ের কারণ হবে। আর কুস্তুন্তুনিয়ার (ইস্তাম্বুলের) বিজয়, দাজ্জালের আবির্ভাবের কারণ হবে। আর দাজ্জালের সাথে যে মহাযুদ্ধ হবে তার নেতৃত্ব দিবেন ঈসা ইবনে মারিয়ম (আঃ)।
দাজ্জাল বিষয়ক হযরত হুজায়ফা (রাঃ) এর বর্ণিত এর সুবিস্তৃত হাদিসে হযরত ঈসা (আঃ) এর আগমনের ঘটনাটি নিম্নরূপ। আল্লাহর রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সত্তর হাজার ইহুদি দাজ্জালের পিছনে থাকবে, যাদের গাঁয়ে তারজানি চাদর জড়ানো থাকবে (তারজানি চাদরও তায়লাসানের মতো সবুজ চাদরকে বলা হয়)। অনন্তর জুমার দিন ফজর নামাজের সময় যখন নামাজের ইকামাত হয়ে যাবে, তখন যেইমাত্র মাহদি মুসল্লিদের পানে তাকাবেন, অমনি তিনি দেখতে পাবেন, ঈসা ইবনে মারিয়ম আকাশ থেকে নেমে এসেছেন। তার পরিধানে দুটি কাপড় থাকবে। মাথার চুলগুলো এমন চমকদার হবে যে, মনে হবে তার মাথা থেকে পানির ফোঁটা ঝরছে”।
একথা শুনে আবু হুরায়রা (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি তার কাছে যাই, তা হলে আমি তার সঙ্গে মু’আনাকা করব কি? উত্তরে রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, “শোনো আবু হুরায়রা, তার এই আগমন প্রথমবারের মতো হবে না। তার সঙ্গে তুমি এমন প্রভাবদীপ্ত অবস্থায় মিলিত হবে, যেমনটি মৃত্যুর ভয়ে মানুষ আতঙ্কিত হয়। তিনি মানুষকে জান্নাতের মর্যাদা ও স্তরের সুসংবাদ প্রদান করবেন। এবার আমিরুল মুমিনীন তাকে বলবে, আপনি সামনে এগিয়ে আসুন এবং লোকদেরকে নামাজ পড়ান। উত্তরে ঈসা বলবে, নামাজের ইকামত আপনার জন্য হেয়েছে। কাজেই ইমামতও আপনিই করুন। এভাবে ঈসা ইবনে মারিয়াম তার পেছনে নামাজ আদায় করবে”।
(আসসুনানুল ওয়ারিদাতু ফিল ফিতান, খণ্ড ৫, পৃষ্ঠা ১১১০)
হযরত মুজাম্মা’ ইবনে জারিয়া আনসারি (রাঃ) বর্ণনা করেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বলতে শুনেছি, “ঈসা ইবনে মারিয়াম দাজ্জালকে ‘লুদ’ এর ফটকে হত্যা করবে।”
(মুসনাদে আহমাদ, খণ্ড ৩, পৃষ্ঠা ৪২০; সুনানে তিরমিজি, হাদিস নং ২২৪৪)
‘লুদ’ বর্তমানে ইসরাইলের অন্তর্ভুক্ত। এটি তেলআবিব থেকে দক্ষিন-পূর্বে ১৮ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত ছোট্ট একটি শহর। ১১৯৯ সালের জরিপ অনুযায়ী এই শহরের জনসংখ্যা ৬১ হাজার ১ শত। ইসরাইল এই শহরে সর্বাধুনিক নিরাপত্তা সমৃদ্ধ বিমানবন্দর স্থাপন করেছে। হতে পারে, দাজ্জাল এখান থেকে বিমানযোগে পালানোর চেষ্টা করবে এবং এই বিমানবন্দরেই তাকে হত্যা করা হবে। মহান আল্লাহ তার শত্রু ও ইহুদীদের খোদা দাজ্জালকে হযরত ঈসা ইবনে মারিয়াম(আঃ) এর হাতে হত্যা করাবেন, যাতে সমগ্র বিশ্ব বুঝতে পারে যে, মানবতার বিষফোঁড়াগুলোকে নির্মূল করতে হলে সেগুলোকে কেটে দেহ থেকে আলাদা করা জরুরী আর এই কাজটি জিহাদেরই মাধ্যমে হয়ে থাকে।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “মুসলমানরা ইহুদীদের সাথে যুদ্ধ না করা পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না। মুসলমানরা ইহুদীদের হত্যা করবে। এমনকি ইহুদীরা পাথর ও গাছের আড়ালে লুকাবে। তখন পাথর ও গাছ বলবে, হে আল্লাহর বান্দা, এই যে আমার পেছনে এক ইহুদি লুকিয়ে আছে; তুমি এসে ওকে হত্যা করো। তবে ‘গারকাদ’ বলবে না। কেননা, সেটি ইহুদীদের গাছ”।
(সুনানে মুসলিম, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ২২৩৯)
ইহুদীদের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ জড় পদার্থগুলোকেও বাকশক্তি দান করবেন। তারাও ইহুদীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিবে। ইসরাইল যখন গোলান পর্বতমালায় দখল প্রতিষ্ঠা করেছে, তখন থেকেই তারা ওখানে ‘গারকাদ’ বৃক্ষ লাগাতে শুরু করেছে। এছাড়াও তারা স্থানে স্থানে এই গাছটি রোপণ করছে। সম্ভবত এই গাছের সঙ্গে তাদের বিশেষ কোন সম্পর্ক আছে।
----